উপকূলীয় নৌপথে বিধি বহির্ভূতভাবে সরকারি নৌযান ইজারা দেয়ার চেষ্টা
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
নৌ-নিরাপত্তা বিধি উপেক্ষা করেই রাষ্ট্রায়ত্ত নৌপরিবহন সংস্থা বিআইডব্লিউটিসি অভ্যন্তরীণ সরকারি যাত্রীবাহী নৌযান ইজারা দেয়ার চেষ্টা করছে। আর বিনা দরপত্রে ওই ইজারার কাজটি করার জন্য সংস্থার ভেতরে ও বাইরে চালানো হচ্ছে নানামুখি তৎপরতা। যদিও ইতিপূর্বে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক সভায় ‘ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যন্স-এর আওতায় নিবন্ধিত কোনো নৌযান উপকূলীয় নৌপথে চলাচলের অনুমতি দেয়া হবে না’ বলে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু তারপরও নিরাপত্তা বিধিসহ মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা অমান্য করে চলতি বছরের শুরুতে বিআইডব্লিউটিসি র অভ্যন্তরীণ যাত্রীবাহী নৌযান ‘এমভি বাঙালী’ টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে ইজারা প্রদান করা হয়। বিআইডব্লিউটিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নৌপরিবহন অধিদফতরের নির্দেশিকায় ১৬ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত শান্ত মওসুম হিসবে গণ্য করা হলেও এমভি বাঙালী নৌযানটি ৩০ মার্চ পর্যন্ত ওই রুটে চলাচলের জন্য ইজারা দেয়া হয়। ১ এপ্রিল নৌযানটি টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামে ফেরত আসে এবং ৪ এপ্রিল ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়। কিন্তু এ দুটি যাত্রাপথেই সাগর উপকূলে উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে নৌযানটি। অভ্যন্তরীণ যাত্রীবাহী ওই নৌযানটি সাগর উপকূল পাড়ি দেয়ার সময় প্রচন্ড ঝড়ের কবলে পড়ায় এর প্রায় সব ক্রু অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুধু প্রধান কাপ্তেন ও ইঞ্জিন কর্মকর্তা কোনোভাবে দায়িত্ব পালন করে নৌযানটিকে রক্ষা করতে সক্ষম হন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ওই নৌযানটি উপকূলীয় রুটে চলাচল করায় এর তলায় বিপুল পরিমাণ শামুক ও প্রবাল বাসা বাঁধে। ফলে নৌযানটি ঢাকায় ফিরে সংস্থার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিক পরিচালন শুরু করার পরে গতি যথেষ্ট হ্রাস পায়। বিষয়টি খতিয়ে দেখে এর তলা থেকে শামুক ও প্রবাল অপসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও এক হাজার টন ওজনের ওই নৌযানটি উত্তোলনের মত কোনো ডকইয়ার্ড না পাওয়া গেলেও সম্পূর্ণ ঝুঁকি নিয়ে একটি বেসরকারী ডকইয়ার্ডের স্লীপওয়েতে তোলা হয়। কিন্তু নৌযানটির প্রায় ৬০ ভাগ এলাকা ডাঙায় তুলে তলা পরিস্কার ও রং করার মধ্যেই রোপ ওয়্যার ছিড়ে পুরো নৌযানটি আকষ্মিকভাবেই পেছনের দিকে নদীতে নেমে যায়। যদিও এতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু ‘তা অস্বাভাবিক ছিল না’ বলে মনে করছেন কারিগরি বিশেষজ্ঞ মহল।
সূত্র জানায়, বিআইডব্লিউটিসি গত ৩ বছওে প্রায় ৫৭ রকাটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের আওতায় দুটি অভ্যন্তরীণ যাত্রীবাহী নৌযান নির্মাণ করে। তার মধ্যে ২০১৪-এর মার্চে ‘এমভি বাঙালী’ ও বছরখানেক বাদে এমভি মধুমতি’ যাত্রী পরিবহনে যুক্ত হয়। কিন্তু ওসব স্বেতহস্তি যাত্রী পরিবহনের পরিবর্তে বসিয়ে রাখলেই সংস্থার লোকসান কম হয়। মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি ও পরিচালন ব্যয়ের কারনে বাণিজ্যিকভাবে কোনোভাবেই ওসব নৌযান পরিচালন সম্ভব নয়। ৫৭ কোটি টাকা ব্যয় সংগৃহীত ওসব নৌযানে গত ৩ বছরে পরিচালন লোকসানের পরিমান দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংস্থাটির দায়িত্বশীল কোনো কোনো কর্মকর্তার সহায়তায় একটি সিন্ডিকেট ওসব নৌযান ইজারা নিয়ে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে পরিচালনের মাধ্যমে মোটা অংকের মুনাফার চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ ‘ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স-আইএসও’ অনুযায়ী কোন অভ্যন্তরীণ নৌযান উপকূলীয় নৌপথে পরিচালনে পরিপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ দু’টি নৌযানই আইএসও’র আওতায় নিবন্ধিত।
সূত্র আরো জানায়, চলতি বছরও আসন্ন শান্ত মওশুমে ‘বে অব বেঙ্গল ট্যুর’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গতবছরের চেয়ে ১০ ভাগ বাড়তি দরে এমভি বঙালী জাহাজটি টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে প্রমোদ ভ্রমণের জন্য ইজারা নিতে নৌপরিবহন মন্ত্রীর কাছে আবেদন করে। মন্ত্রী ‘বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের’ জন্য বিআইডব্লিউটিসি’র চেয়ারম্যানকে বলেছেন। অপরদিকে নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক গত ৬ জুলাই এ সংক্রান্ত এক চিঠিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ২০১৫-এর ১৭ সেপ্টেম্বর সভার সিদ্ধান্তের আলোকে ‘ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স-আইএসও’র আওতায় নিবন্ধিত কোন অভ্যন্তরীণ নৌযানের উপকূলীয় এলাকায় চলাচলের সুযোগ নেই’ বলে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে নৌপরিবহন অধিদফতরের পক্ষ থেকে অনুমোদন প্রদানে অপারগতার কথাও জানান হয়। কিন্তু তারপরও বিআইডব্লিউটিসির বাণিজ্য পরিদফতরের একটি মহল সম্পূর্ণ বিনা দরপত্রে সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ যাত্রীবাহী নৌযান উপকূলীয় রুটে ইজারা দেয়ার আগ্রহের বিষয়টি সুস্পষ্ট। ‘বে অব বেঙ্গল ট্যুর’ গতবছর মাসে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে এমভি বাঙালী নৌযানটি ইজারা গ্রহণ করে। চলতি বছর ১০ শতাংশ বাড়তি দরে তারা নৌযানটি ইজারা গ্রহণের প্রস্তাব দিলেও সেজন্য বিআইডব্লিউটিসি কোন দরপত্র আহবান করেনি। উপরন্তু নৌপরিবহন মন্ত্রীর কাছে আরো একাধিক প্রতিষ্ঠান টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে পরিচালনের জন্য একই নৌযান ইজারা গ্রহণের আবেদন করলে মন্ত্রী সবগুলো আবেদনপত্রেই ‘বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ’র কথা বলেছেন বলে জানা যায়। ওসব আবেদনকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আরো বেশি দরে নৌযানটি ইজারা নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু সংস্থার একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সম্পূর্ণ বিনা দরপত্রে সরকারি নৌ নিরাপত্তা বিধি উপক্ষো করেই অভ্যন্তরীণ রুটের নৌযান উপকূলীয় পথে প্রমোদ ভ্রমণে ভাড়া দিতে আগ্রহী বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারি কোনো নৌযান দরপত্র আহবান ছাড়াই এ ধরনের ইজারা প্রদানকে বেআইনি বলেছেন দায়িত্বশীল মহল।
এ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. জ্ঞান রঞ্জন শীল জানান, বিষয়টি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। এজন্য কোনো দরপত্রও আহবান করা হয়নি। মন্ত্রণালয়ের চুড়ান্ত অনুমোদন ব্যতিরেকে কোন কিছু করা হবে না।