দ্বিতীয় শীর্ষ আমদানি পণ্য এখন পাথর
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
এক দশক আগেও ভবন এবং সড়ক নির্মাণের প্রধান উপকরণ ছিল ইটের খোয়া। এখন দিন বদলেছে, টেকসই নির্মাণসামগ্রী হিসেবে ইটের খোয়ার জায়গা দখল করে নিচ্ছে পাথর। এই পরিবর্তন কতটা দ্রুত হচ্ছে তা একটি তথ্যেই পরিষ্কার। দেশে এখন যত পণ্য আমদানি হয়, তার মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে পাথর।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই ও আগস্ট) পাথর আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৭১ হাজার টন। ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভিয়েতনাম এবং মালয়েশিয়া থেকে পাথর আমদানি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পাথর আমদানি হয় ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপ জাহাজে করে একটি চালানে ১২ হাজার ৫০০ টন পাথর আমদানি করে। এই প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়ালসড়ক নির্মাণ করছে। এ পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার টন পাথর আমদানি করেছে ম্যাক্স। উড়ালসড়কের অসমাপ্ত কাজের (ওঠানামার রাস্তাÑর্যা ম্প) জন্য আরও ৪০ হাজার টন পাথর আমদানি করবে প্রতিষ্ঠানটি।
ম্যাক্স গ্রুপের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. মনির হোসেন বলেন, দেশীয় উৎস সীমিত হয়ে পড়ায় বিদেশ থেকে আমদানি করে পাথরের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। প্রকল্পের গুণগত মান বজায় রাখতে ভালো মানের পাথর আমদানি করছেন তাঁরা।
এর আগে শুধু স্থলবন্দর দিয়ে সীমিত আকারে পাথর আমদানি হতো। ঢাকা ও চট্টগ্রামে একের পর এক উড়ালসড়ক নির্মাণ, পদ্মা সেতুসহ বড় প্রকল্পের জন্য হঠাৎ করেই দেশে পাথরের চাহিদা বেড়ে গেছে। চট্টগ্রাম কাস্টমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পাথর আমদানি হয় ৩২ লাখ টন। এর আগের অর্থবছরে পাথর আমদানি হয়েছিল ৪ লাখ ১২ হাজার টন।
নির্মাণ প্রকৌশলীরা বলেন, পাথরের চেয়ে ইটের খোয়ার শক্তি ৪০ ভাগ কম। এ কারণে ভবন নির্মাণে ইটের খোয়ার ব্যবহার ১০ বছর ধরেই কমছিল। তাঁরা বলেন, বাজারে এখন সবচেয়ে ভালো মানের ইটের খোয়া বিক্রি হচ্ছে টনপ্রতি ২ হাজার ৭৫০ টাকায়। অন্যদিকে আমদানি করা প্রতি টন চূর্ণ পাথর বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৩০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। খরচ কিছুটা বেশি পড়লেও স্থায়িত্বের কারণে ভবন নির্মাণে পাথরের ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
দেশে ভালো মানের পাথরের একমাত্র উৎস পেট্রোবাংলার অধীন দিনাজপুরের পার্বতীপুর এলাকার মধ্যপাড়া পাথরের খনি। যন্ত্রপাতির সমস্যার কারণে গত দুই বছর সেখানে পাথর তোলা বন্ধ ছিল। সম্প্রতি এই খনি থেকে সীমিত পরিসরে আবার পাথর তোলা শুরু হয়েছে।
মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহমুদ খান বলেন, উন্নয়ন-কর্মকা-ের কারণে এখন বছরে পাথরের চাহিদা রয়েছে ৬০-৭০ লাখ টন। খনি থেকে পাথর তোলা শুরু হওয়ায় এই চাহিদার একাংশ দেশীয় উৎস থেকে মেটানো যাবে। খনির উত্তোলন ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১৮ লাখ টন।
এই খনি ছাড়াও সিলেটের বিভিন্ন কোয়ারি থেকে পাথর তোলা হতো। নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক কোয়ারিতে পাথর তোলা বন্ধ রয়েছে। এসব কারণেও আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে।
কাস্টমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণের দিক থেকে ২২তম অবস্থানে ছিল পাথর। গত অর্থবছরে তা চতুর্থ অবস্থানে উঠে আসে। চলতি অর্থবছরের দুই মাসের হিসাবে পাথর এখন দ্বিতীয় শীর্ষ আমদানি পণ্য। আমদানির পরিমাণের হিসাবে শীর্ষস্থানে রয়েছে সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকার। গত দুই মাসে ক্লিংকার আমদানি হয়েছে ২০ লাখ ৮৬ হাজার টন। আমদানির হিসাবে গমের অবস্থান তৃতীয়। এর পরে ডিজেল, স্ল্যাগ (সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল), ফার্নেস তেল, স্ক্র্যাপ (পুরোনো লোহা), কাঁচা তুলা, চাল ও সয়াবিন দানা। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রায় চার হাজার ধরনের পণ্য আমদানি হয়।
প্রকৌশলীরা বলছেন, শুধু পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো, নদীশাসন ও সংযোগ সড়ক নির্মাণে ৭০ লাখ টন পাথরের প্রয়োজন হবে। চট্টগ্রামের লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রয়োজন হবে সাড়ে ৭ লাখ টন পাথর। আবার চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে দরকার হবে প্রায় পৌনে ৬ লাখ টন পাথর।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি পাথর আমদানি করেছে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজে যুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাইরং-স্পেক্ট্রা জেবি। প্রতিষ্ঠানটি ২ লাখ ৬৩ হাজার টন পাথর আমদানি করেছে।
বছরে ১০০ শতাংশ হারে পাথরের চাহিদা বাড়ছে বলে জানান প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক। তিনি বলেন, ভবন, সেতু, সড়ক, উড়ালসড়কসহ সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে এখন পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে। আগামি অর্থবছরেই পাথর আমদানির পরিমাণ ১৪০ লাখ টনে পৌঁছাতে পারে।