মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের বন্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিপাকে সরকার
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
সরকারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ স্ট্রাস্টের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যবস্থাপনার ঘাটতি ও দুর্নীতির কারণে গত দুই যুগে ট্রাস্টের ২৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে তিনটি প্রতিষ্ঠান চালু থাকলেও তার মধ্যে লাভজনক রয়েছে মাত্র একটি। বন্ধ ওসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪শ’ কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য প্রতিবছর ট্রাস্টের ব্যয় হচ্ছে ১৮ কোটি টাকা। নানামুখী তৎপরতা সত্ত্বেও গত ৮ বছরে বন্ধ থাকা একটি প্রতিষ্ঠানও চালু করা সম্ভব হয়নি। বন্ধ থাকা ২৯টি প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি ও ১০১ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে সরকার এখন বিপাকে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ২২টি লাভজনক প্রতিষ্ঠান নিয়ে ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে। পরে জিয়া ও এরশাদ সরকার ট্রাস্টে ৯টি প্রতিষ্ঠান যুক্ত করায় মোট প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায় ৩২টিতে। কিন্তু লাভজনক ওসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠানই এরশাদের আমলের শেষ দিকে এবং ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসা বিএনপি সরকারের ৫ বছরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও তখন থেকে ব্যবস্থাপনার ঘাটতি ও দুর্নীতির কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ২৯টিতে। গত ৮ বছরে ওসব প্রতিষ্ঠান একাধিকবার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছিল। কিন্তু পরিচালনায় ব্যবস্থাপনার ঘাটতি ও দুর্নীতির কারণে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে ট্রাস্টের ১৪টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ২০০২ সালে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গঠনের পর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টসহ এর আওতাধীন সব প্রতিষ্ঠান ওই মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়। তখন থেকে ট্রাস্টের বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোও একে একে বন্ধ হতে শুরু করে। এখন ট্রাস্টের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৯টি বন্ধ রয়েছে।
সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ওসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলেও বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের জন্য বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় ট্রাস্টের অধীনে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকলেও এখন আছে মাত্র ৪শ’। ওসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা এবং অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেনশনসহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে কল্যাণ ট্রাস্ট। বর্তমানে যে তিনটি প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে সেগুলো হলো- ঢাকার পূর্ণিমা ফিলিং অ্যান্ড সার্ভিস স্টেশন, চট্টগ্রামের ইস্টার্ন কেমিক্যাল লিমিটেড ও ঢাকার মিমি চকলেট লিমিটেড। তার মধ্যে ফিলিং স্টেশন ছাড়া অন্য দুই প্রতিষ্ঠান দেনার দায়ে জর্জরিত। এখন ট্রাস্টের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে ১৬০ কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর)। তার মধ্যে ৪২ কোটি টাকার এফডিআর থেকে পাওয়া লভ্যাংশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু ছাত্রবৃত্তি’ দেয়া হয়। ১১৮ কোটি টাকার এফডিআর থেকে লভ্যাংশ বাবদ পাওয়া মাসিক ৬৯ লাখ টাকা এবং গুলিস্তানসহ কয়েকটি মার্কেটের ভাড়া ও পূর্ণিমা ফিলিং স্টেশন মিলিয়ে পাওয়া ৭৩ লাখ টাকা দিয়ে বর্তমানে ট্রাস্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে। তারপরও অর্থাভাবে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্যান্য পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না ট্রাস্ট। কল্যাণ ট্রাস্টের বেহাল অবস্থার জন্য মূলত বিভিন্ন সরকারের আমলের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিই প্রধান কারণ। এর ফলে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কল্যাণ ট্রাস্টের অস্তিত্ব রক্ষা করা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, লোকসান কমিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ট্রাস্টকে লাভজনক করার জন্য বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব জমি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, সেসব স্থানে বাণিজ্যিক ও আবাসিক বহুতল ভবন নির্মাণের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। তার মধ্যে গাজীপুরের কুনিয়া মৌজার ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের গজনবী রোডের ১/৬ প্লটের দশমিক ২২ একর, চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের ১ দশমিক ৯৩ একরসহ ১১টি প্রতিষ্ঠানের জমিতে ডেভেলপারের মাধ্যমে ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দেয়ার প্রস্তাবনা আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে। সর্বশেষ গত ১৭ অক্টোবর ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয়ে এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে। ট্রাস্ট সংশ্লিষ্টরা মতে, ট্রাস্টের পুরো কার্যক্রম বাণিজ্যিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। সেজন্য সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি। কিন্তু ২০০২ সালে ট্রাস্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে যাওয়ার পর থেকে চিঠি চালাচালি করতে গিয়েই সিদ্ধান্তহীনতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাছাড়া নেতৃত্বের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি তো রয়েছেই।
এদিকে এ প্রসঙ্গে ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আজাহারুল হক জানান, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে গত এক বছরে বন্ধ থাকা কোম্পানিগুলো চালুর বিষয়ে অনেক চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু মামলাসহ বিভিন্ন কারণে খুব একটি সফল হতে পারিনি। তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে। আর্থিক ক্ষতি কমিয়ে এনে আগ্রহী সরকারি বা বেসরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করেও যদি দু-একটি কোম্পানি চালু করা যায়, তাহলে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে তা-ও করা হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানান, বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করে ট্রাস্টকে লাভজনক করার জন্য চেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই প্রতিষ্ঠানগুলোর খোঁজখবর নেন। গত কয়েক বছরে কল্যাণ ট্রাস্টের ৩শ’ কোটি টাকার বেশি ঋণ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মওকুফ করা হয়েছে।