রাজধানীতে চলাচলকারী গণপরিবহনের ভাড়া নৈরাজ্যের বিষয়টি মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে আসে। রাজধানীর গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগও দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি ‘সিটিং সার্ভিসের নামে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে রাজধানীতে চলাচলকারী ৯৬ শতাংশ বাসেই ভাড়া নৈরাজ্য চলছে- এমনই এক উদ্বেগের চিত্র উঠে এসেছে। বাস্ত্মবতা হলো, বাসভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যের বিষয়টি সংশিস্নষ্ট সবমহল অবগত থাকলেও তা নিরসনে এ পর্যন্ত্ম কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিষয়টি নিতান্ত্মই পরিতাপের।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে যাত্রী দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, সিটিং সার্ভিসের নামে ভাড়া নৈরাজ্য ও পিকআওয়ারে দরজা বন্ধ করে বাসচলাচলের কারণে মাঝপথের যাত্রীরা রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে-পুড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্ত্মায় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থেকেও বাস পাচ্ছেন না। এ ছাড়া একই দূরত্বে একেক বাসে একেক হারে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। রাজধানীতে দীর্ঘদিন ধরেই এভাবে যাত্রীরা দুর্ভোগের শিকার হয়ে আসছে। এ ছাড়া বাসশ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রী বচসাও নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিটিং সার্ভিসের নামে বাস চলাচল বন্ধে এর আগে সংশিস্নষ্টরা উদ্যোগ নিলেও তাতে যাত্রী দুর্ভোগের কোনো সুরাহা হয়নি। রাজধানীর পরিবহন মালিকরা বরাবরই যাত্রীস্বার্থ উপেক্ষা করে এলেও আইন অনুযায়ী তাদের বিরম্নদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এমনও দেখা গেছে, বেসরকারি মালিকদের চাপের মুখে সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির বাসও রাস্ত্মায় চলাচল করতে পারে না। এসব মালিকরা নিজেদের মতো করে সার্ভিস চালু করে নিজেদের নির্ধারিত ভাড়া আদায় করে যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, দিন দিন এই অত্যাচারের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মালিকদের জন্য লাভজনক এই সার্ভিসে সরকার সংশিস্নষ্টরা যুক্ত থাকায় এই নৈরাজ্যের অবসান ঘটছে না- এমনও মনে করছেন কেউ কেউ।
তথ্য মতে, বিআরটিএ কর্তৃপক্ষও স্বীকার করেছে- বিআরটিএর আইনে সিটিং সার্ভিস বলতে কিছুই নেই। মালিকরা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে এসব বিষয় আবিষ্কার করেছে। সঙ্গত কারণে এমন প্রশ্ন উঠে আসা অযৌক্তিক হতে পারে না যে, নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে সরকার সংশিস্নষ্টদের নাকের ডগা দিয়ে মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে সিটিং সার্ভিস পরিচালনা করলেও তাদের বিরম্নদ্ধে কেন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? আমরা মনে করি, যাত্রী হয়রানি ও ভাড়া নৈরাজ্যের এ দায় সংশিস্নষ্টরা অস্বীকার করতে পারেন না।
স্মর্তব্য যে, গণপরিবহন থেকে যাত্রীস্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। একদিকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য, অন্যদিকে অতিরিক্ত যাত্রী বহন, সিটিং গাড়িতে দাঁড়িয়ে যাত্রী বহনের কারণে যাত্রী, চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে প্রায়ই বচসা, হাতাহাতি-মারামারির ঘটনাও ঘটছে। যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেও প্রশাসন, মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, বিআরটিএ বা পুলিশ কারও কোনো সহযোগিতা মেলে না। ফলে এসব নৈরাজ্যের কাছে যাত্রীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এভাবে একটি দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা চলতে পারে না। জানা যায়, রাজধানীতে যেসব গণপরিবহন সিটিং সার্ভিসের নামে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে, এর অধিকাংশ পরিবহনের মালিক সরকার সংশিস্নষ্টরা রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। ফলে নৈরাজ্যের বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদ করেও কোনো ফল নেই। পুলিশ প্রশাসনও নিশ্চুপ। এ পরিস্থিতি নিরসনে সরকারের সংশিস্নষ্ট বিভাগও যেন গভীর ঘুমে অচেতন। ফলে এ নৈরাজ্যের অবসান হওয়া সুদূর পরাহত বলেই অনুমান করা যায়। গণপরিবহনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে সরকারের সংশিস্নষ্ট বিভাগের এই নতজানু নীতির অর্থ হতে পারে নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ। বাস মালিকদের হাতে জনগণ জিম্মি থাকবে আর সংশিস্নষ্ট বিভাগ বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যে তাদের কর্মকা- সীমিত রাখবে এটা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
সর্বোপরি বলতে চাই, যাত্রীস্বার্থ বিবেচনা করে সরকারের কর্তব্য হওয়া দরকার যে কোনো মূল্যে রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। রাজধানীতে কি প্রক্রিয়ায় বাস চলাচল করবে তা সংশিস্নষ্ট বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া যেসব মালিক আইনের ব্যত্যয় ঘটাবেন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা কর্তব্য। আমরা প্রত্যাশা করব, সরকার এমন উদ্যোগ নিক যাতে রাজধানীর গণপরিবহনের এ নৈরাজ্যের অবসান ঘটে।