২১ অগাস্ট মামলায় যুক্তি উপস্থাপন শেষ, আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার দাবি রাষ্ট্রপক্ষের
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হতাহতের ঘটনায় আনা মামলার আসামীদের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ মামলায় গতকাল সোমবার ২৫তম দিনে য্ুিক্ততর্ক উপস্থাপন সমাপ্ত করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিনের আদালতে এ মামলার বিচার চলছে। গতকাল সোমবার আদালত আদেশে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এ পর্যায়ে যুক্তিতর্কের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। পলাতক আসামীদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবীদের কাল যুক্তিতর্ক পেশের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ মামলায় সংবাদ সংগ্রহে আগত গণমাধ্যম কর্মীদের ধন্যবাদ জানায় আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সিনিয়র অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান আইনি পয়েন্টে যুক্তি পেশ করেন। মামলার সকল আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অপরাধ স্বতন্ত্র, নিঃস্বার্থ, দালিলিক ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষীদের দ্বারা দেয়া সাক্ষ্যে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে বলে দাবি করেন প্রধান কৌঁসুলি। তিনি আদালতে বলেন, ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচার প্রার্থী মানুষের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে আইনের বিধানের আলোকে আসামীদের প্রত্যেককে সর্বোচ্চ সাজা প্রার্থনা করছি। প্রধান কৌঁসুলি যুক্তিতর্ক পেশকালে আসামীদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ ও দৃষ্টান্তমূলক দন্ডের স্বপক্ষে বিভিন্ন মামলায় দেয়া উচ্চতর আদালতের বেশকিছু সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন। মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মার্ডার কেস, জঙ্গী হামলায় নিহত ঝালকাঠি আদালতের বিচারক জগন্নাথ পাড়ে হত্যা মামলা ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী হত্যা চেষ্টা মামলা। সৈয়দ রেজাউর বলেন, উল্লিখিত মামলাসমূহের সিদ্ধান্তের আলোকেও সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকে রাষ্ট্রপক্ষ আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট পরিচালিত ওই গ্রেনেড হামলার লক্ষ্য ছিলো আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যা করা। এতে করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বশূন্য হতো। যাতে ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার অসৎ উদ্দেশ্য। যুক্তিতর্কে রাষ্ট্রপক্ষ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক, বিভিন্ন সরকারী ও প্রশাসনিক সহযোগিতার তথ্য-প্রমাণ পেশ করেন। তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয় বনানীর হাওয় ভবন, বিএনপি-জামায়াাত সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু’র সরকারি বাসভবনসহ য়ড়যন্ত্রমূলক সভার স্থানসমূহ তথ্য-প্রমাণের আলোকে তুলে ধরেন। প্রধান কৌঁসুলি বলেন, ওই হামলার আরো অভিপ্রায় ছিলোÑ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী শক্তি বিএনপি-জামায়াত জোট শক্তির উত্থান ঘটানো। জঙ্গি সংগঠন হুজির (হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী) কর্মকা- নির্বিঘেœ পরিচালনা করা। তিনি বলেন, কাশ্মীর, পাকিস্তান ও মায়ানভিত্তিক ভিনদেশী জঙ্গি সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীন, লস্কর-ই-তৈয়বা, তেহরিক-ই-জিহাদী ইসলাম, রোহিঙ্গা সলিটারিটি অরগাইজেশন (আরএসও)-এর জঙ্গি কর্মকা- নির্বিঘœ করা এবং অসৎ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে অবৈধ অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদি মজুদ ও পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার অভিপ্রায় ছিলো ওই হামলা। প্রধান কোঁসুলি যুক্তিতর্কে বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলার আসামীদের অভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শুন্য করে, দেশকে অস্থিতিশীল ও জঙ্গিরাষ্ট্রে পরিণত করতে পরিকল্পিতভাবে ওই হামলা পরিচালিত হয়। তিনি এ মামলার এজাহার, বিভিন্ন কর্মকর্তার তদন্ত, বিভিন্ন আলামত নষ্ট করার ঘটনা, আসামীদের নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে সহায়তা, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিসমূহ পর্যালোচনা করে যুক্তি পেশ করেন। ঘটনা ঘটার সময় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার বিষয়ে জড়িত কর্মকর্তাদের ভূমিকা যুক্তিতর্কে তুলে ধরেন। ২১ আগস্ট ঘটনার পূর্বে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের সভা, সভাস্থল, জড়িতদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ সাক্ষ্যের আলোকে যুক্তিতর্কে তুলে ধরেন। আওয়ামীলীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানসহ তার সহযোগীদের পরিচালিত বিভিন্ন তৎপরতার তথ্য যুক্তিতর্কে পেশ করেন। প্রকৃত আসামীদের আড়াল করতে নিরীহ জজমিয়াসহ অন্য নিরীহদের মামলায় সম্পৃক্ত করার সঙ্গে দায়ী আসামীদের বিষয়ে যুক্তি পেশ করেন। রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী, প্রভাবশালী শীর্ষ নেতা, প্রশাসনের প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তাগনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা পরস্পর যোগসাজসে ঘটিয়েছেন। মামলায় সাক্ষিদের দেয়া জবানবন্দির আলোকে ২৭ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গত ২৩ অক্টোবর থেকে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক শুরু হয়। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ২২৫ জন সাক্ষি (পিডব্লিউ) ও আসামীপক্ষে ২০ জনের সাফাই সাক্ষ্য (ডিডব্লিউ) পর্যালোচনা করে আদালতে যুক্তিতর্কে পেশ শেষ করা হয়। প্রধান কোঁসুলিকে যুক্তিতর্ক পেশে আরো সহায়তা করছেন আইনজীবী আকরাম উদ্দিন শ্যামল ও ফারহানা রেজা। এ ছাড়াও রাষ্ট্রপক্ষে পিপি খন্দকার আবদুল মান্নান, মোশাররফ হোসেন কাজল, স্পেশাল পিপি মো. আবু আব্দুল্লাহ ভুঞা, আবুল কালাম আজাদ, মো. আমিনুর রহমান, আবুল হাসনাত, শেখ সিরাজুল ইসলাম সিরাজ, কাজী ইলিয়াসুর রহমান, আশরাফ হোসেন তিতাস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে আসামিপক্ষে বিভিন্ন আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন। ২১ আগস্টের ওই নৃশংস হামলায় পৃথক দুটি মামলায় মোট আসামি ৫২ জন। মামলার আসামি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ২৩ জন কারাগারে রয়েছে। এ মামলায় পুলিশের সাবেক আইজি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদাবক্স চৌধুরী, লে.কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক এবং মামলার সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তা- সিআইডি’র সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সিআইডি’র সাবেক এএসপি আতিকুর রহমান ও আবদুর রশিদসহ মোট ৮ জন জামিনে রয়েছেন। তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, মেজর জেনারেল (এলপিআর) এটিএম আমিন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দারসহ ১৮ জন এখনো পলাতক। এ ছাড়া ৩ জন আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুফতি হান্নান ও শরীফ সাইদুল আলম বিপুলের অন্য মামলায় মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ায় এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পলাতক আসামীদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী রয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ওই নৃশংস হামলায় ২২ জন নিহত ও নেতকর্মী-আইনজীবী-সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক লোক আহত হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পতœী আইভি রহমান। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্যান্য নেতা এই গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যান। এতে অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচন্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।