বিদ্যুতের দাম
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। ডিসেম্বর থেকে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিটে এই মূল্য বাড়বে ৩৫ পয়সা হারে, সারাদেশে গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এবার দাম বাড়ার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে বিদ্যুত উৎপাদনরত কোম্পানিগুলোর বিতরণ বাবদ খরচ। উল্লেখ্য, এবারই প্রথম পাইকারি দর ঠিক রেখে গ্রাহক পর্যায়ে ঠুনকো যুক্তি দেখিয়ে বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে সর্বস্তরে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম কি পরিমাণ বাড়বে তা আদৌ বিবেচনায় না নিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন তথা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থই সর্বদা বড় করে দেখে (বিইআরসি)। বর্তমানে চাল-ডাল-ভোজ্যতেল-পেঁয়াজ ও অন্যবিধ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবন এমনিতেই আতঙ্ক। সে অবস্থায় বিদ্যুতের আবারও মূল্যবৃদ্ধি গ্রাহকের জন্য হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের শামিল। এর ফলে পণ্য উৎপাদন ও ব্যবসাবাণিজ্যের ব্যয় বাড়বে সর্বত্র। অভ্যন্তরীণ বাজারের উৎপাদকের পাশাপাশি রফতানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়বে। জনজীবনে সৃষ্টি হবে অসন্তোষ। সামনেই নির্বাচন এমতাবস্থায় বিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণে এবং প্রস্তাবিত দাম বৃদ্ধি বাতিল করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। কেননা, ক্রমাগত গ্যাস-বিদ্যুত-পানি-হোল্ডিং ট্যাক্স ইত্যাদির মূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের পিঠ প্রায় ঠেকে গেছে দেয়ালে।
দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য বিদ্যুত সমস্যার সমাধান। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সরকার ২০১৬ সাল নাগাদ ১৬ হাজার মেগাওয়াট, ২০২৪ সাল নাগাদ ২৪ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৩০ সাল নাগাদ ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সরকার তার উদ্দেশ্য পূরণে অনেকটাই সফল হয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে এবং এর সুফল পাচ্ছে ৭০ শতাংশ মানুষ। আগামি ২০২১ সালের মধ্যে সরকার ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। এর পাশাপাশি সরকার দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে শিল্পোৎপাদনেও নতুন বিদ্যুত সংযোগ দিতে সমধিক আগ্রহী। এর জন্য নতুন ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিনিয়োগ ও শিল্পে উৎপাদন বাড়ানোর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ দেশকে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করে তোলা। সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুত বিভাগ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে অনেকটাই সফল হবে বলে আশা করা যায়।
সঙ্গত কারণেই সরকার যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের ওপর সবিশেষ জোর দিয়েছে, এটিও প্রশংসার যোগ্য। বর্তমান বিশ্ববাজারে জ¦ালানি তেলের দাম বেশ কমলেও আমদানি করতে হয় বিধায় এটি নিঃসন্দেহে ব্যয়বহুল। সে তুলনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র ব্যয়সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও সুলভ। আপাতত আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে চাহিদা মেটানো হলেও বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ির কয়লা উত্তোলন করে ব্যবহার করা হলে উৎপাদন খরচ আরও কমে আসবে। পরিবেশের ওপর কিছু বিরূপ প্রভাব পড়লেও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে কার্বন নিঃসরণও অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। এর পাশাপাশি গ্রীষ্মম-লীয় দেশ বিধায় পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুত এবং বায়ু বিদ্যুতের একাধিক প্রকল্প ও পরিকল্পনা নিয়েও অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। এ সবই দীর্ঘমেয়াদী জ¦ালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রভূত সহায়ক হবে। তখন আর ভাড়া ও তেলভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের অজুহাতে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না।