নীলফামারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ: অনিয়মেই যেখানে নিয়ম
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
একটি বে-সরকারী প্রতিষ্ঠানের তিন কক্ষের টিনসেড ঘর। একটি কক্ষের ছাউনির টিন ভেঙ্গে যাওয়ায় দেখা যাচ্ছে আকাশ। অপর একটি কক্ষে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কয়েক জোড়া বেঞ্চ। দীর্ঘদিন এ কক্ষটি ব্যবহার না করায় বেঞ্চের উপর জমেছে ধুলোর স্তর। মেঝেতেও আবর্জনার স্তুপ। তৃতীয় কক্ষটিতে নেই কোন চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ। পুরো কক্ষ জুড়ে ধুলো-বালু আর আবর্জনার পুরু স্তর। একটি কক্ষ ব্যবহার হচ্ছে অফিস হিসেবে। এখানেও নেই মানসম্মত চেয়ার-টেবিল। নেই কোন বারান্দা। শিক্ষার্থীদের পদচারনা না থাকায় মাঠে জন্মেছে আগাছা। স্তুপ করে রাখা হয়েছে পাশের বাড়ির খড়কুটো। মাঠে চড়ছে গবাদি পশু। প্রতিবেশিরা মাঠে শুকাতে দিয়েছে কাপড়-চোপড়। অফিস কক্ষে নেই জাতীর পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি। উত্তোলন করা হয়না জাতীয় পতাকা। একটি বে-সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিনকক্ষের টিনসেড ঘরে ভাড়ায় চালানো হচ্ছে নীলফামারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। গত বৃহস্পতিবার নীলফামারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজে গিয়ে দেখা গেছে এমনই চিত্র। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল এক ব্যক্তি জানান, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নীলফামারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর টানা ১০বছর মশিউর রহমান ডিগ্রি কলেজের একটি সম্প্রসারিত কক্ষে চালানো হয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। ২০১৬ সালে কানিয়ালখাতা নিম্ম মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের একটি পরিত্যাক্ত ভাঙ্গাচোরা ঘরে ভাড়ায় শুরু করা হয় এর পাঠদান। এক বছর মেয়াদী এই প্রশিক্ষনকে ভাগ করা হয়েছে দুইটি সেমিষ্টারে। এ কোর্সে শতাধীক শিক্ষার্থী ভর্তি দেখানো হলেও নেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থী হাজিরা খাতা আর ক্লাস রুটিন। পাঠদানের অনুকূল পরিবেশ না থাকায় প্রতি শুক্রবার কিছু শিক্ষার্থী আর দুই/একজন শিক্ষক এলেও সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোতে কোন শিক্ষক-শিক্ষার্থী কলেজে আসেন না। কলেজ ভবনের ছাউনির টিন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় শুকনো মৌসুমে সুর্যের খরতাপে ও বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিরে কারণে শ্রেনী কক্ষে শিক্ষার্র্থীরা ক্লাস করতে পারেন না। অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলাম ঢাকায় অবস্থান করায় তার দায়িত্ব পালন করেন পরিচালনা পর্যদের এক প্রভাবশালী সদস্য। কলেজের অফিস সহকারী মোতাহার হোসেন জানান, অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলাম ঢাকায় থাকেন। কলেজে তিনি কখনই আসেন না। এখানে যে টাকা পয়সা আয় হয় তার থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেয়ার পর অবশিষ্ট টাকা ঢাকায় তার কাছে পাঠিয়ে দিতে হয়। পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য এসব দেখাশুনা করেন। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারী হাজিরা খাতা কলেজে নেই। অন্যখানে রাখা আছে। কলেজ মাঠে খড়ের গাদা, কাপড় শুকানো, আগাছা জন্মানো ও গরু চড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের পাশে মানুষের বসত বাড়ি। সীমানা প্রাচীর না থাকায় তারাই মাঠটি ব্যবহার করে থাকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, শিক্ষার্থী প্রতি ভর্তি ফি আদায় করা হয় সাড়ে ছয় হাজার টাকা। এক বছর মেয়াদী দুই সেমিষ্ঠারের কোর্সে প্রতিজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নেয়া হয় ৪০হাজার টাকা। কাগজে কলমে শতাধীক শিক্ষার্থী ভর্তি দেখানো হলেও বাস্তবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০জনের অধিক নয়। এসব ভুয়া শিক্ষার্থী ভর্তি দেখিয়ে অবাধে করা হচ্ছে সনদ বানিজ্য। এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার কোন অনুকূল পরিবেশ নেই। আমরা বাধ্য হয়েই এখানে পড়তে এসেছি। কলেজ পরিচালনা পর্যদের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম জানান, জমি কিনে ভবন নির্মান করে নিজস্ব ক্যাপাসে কলেজ স্থানান্তরে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়ন আজও হয়নি। এতে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাকে দেখানো হয়েছে বুড়ো আঙ্গুল। কলেজের আয় ব্যয়ের কোন হিসাব পরিচালনা পর্যদের কাছে তুলে ধরা হয়না। অধ্যক্ষ ঢাকায় বসে এই কলেজটিকে ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুকে পরিনত করেছেন। তার এই সীমাহীন দুর্নীতির কারণে কলেজটির আজ এই বেহাল দশা। পরিচালনা পর্যদের অপর এক প্রভাবশালী সদস্য ওয়াহীদুজ্জামান সিদ্দিকী কলেজের কর্ণধারে পরিনত হয়েছেন। তিনি এখন অলিখিত মালিক। অধ্যক্ষের দীর্ঘ অনুপস্থিতির সুযোগে পরিচালনা পর্ষদের এই সদস্য আয়ের সব টাকা পকেটস্থ করছেন। নীলফামারীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো: শাহীনুর আলম বলেন, এই কলেজ সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নেই। এটি আমি দেখিওনি। পরিদর্শনে গিয়ে যদি কোন অনিয়ম পাওয়া যায় তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।