ঘোমটা মুখে দাঁড়ানো মেয়েটির ছবি তোলা যাচ্ছিলো না। প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো ক্যামেরা থেকে আড়াল হওয়ার জন্য। স্পষ্টত চেহারায় আভিজাত্যের ছাপওয়ালা মেয়েটি শেষে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হলো। তার নাম হামিদা। মায়ের সঙ্গে মিয়ানমারের বুচিদং টমবাজার থেকে পালিয়ে ঠাঁই হয়েছে কক্সবাজারের কুতুপালং অস্থায়ী রোহিঙ্গা বস্তিতে। অকপটে জানালো আসার পর থেকে স্বস্তিতে নেই মা-মেয়ে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের চলমান হামলার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশই হামিদার মতো অবিবাহিত তরুণী। প্রাণ বাঁচাতে নিজ দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসলেও এসব তরুণীদের প্রতিনিয়ত তাড়া করছে এ দেশীয় লম্পট ও দালালদের কালো হাত। এ নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন রোহিঙ্গা তরুণীরা।
নিজের চোখের সামনে বাবাকে গুলি করে হত্যা করতে দেখা হামিদা বললেন, বাবাকে চোখের সামনে মরতে দেখেছি। নিজের প্রাণ বাঁচাতে চরম আতঙ্ক নিয়ে পালিয়ে এসেছি। কিন্তু এখানে এসেও শান্তি নেই। প্রতিনিয়ত লম্পটদের কালো হাত তাড়া করছে। এই আতঙ্কের কারণে একটুও শান্তি পাচ্ছি না।
কণ্ঠ আরো জোরালো করে বললো, আশ্রয় নিতে এসেছি,দেহ ব্যবসা করতে আসিনি।
মেয়ের নিরাপত্তাহীনতায় মা আলেয়া খাতুনের মুখে চিন্তার ছাপ আরো স্পষ্ট। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, নিজ দেশ ছেড়ে জান বাঁচাতে পালিয়ে এসেছি। মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেও বিপদ পিছু রয়েছে। আমার খুব ভয়, না জানি মেয়েটা হাতছাড়া হয়ে যায়। তাই রাতদিন মেয়েকে নিজ হাতে ধরে রাখছি।
শুধু হামিদা নয় অনেকের সাথেই কথা বলে জানা যায়, ভাড়া নিয়ে দালালদের বিড়ম্বনা, নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল সেট কেড়ে নেয়া, গরু-ছাগল-মহিষ লুটপাট করা, পানি-খাবার সংকট ইত্যাদির পাশাপাশি চরম সমস্যায় ভুগছেন রোহিঙ্গা তরুণীরা।
যেসব মা অথবা বাবার কাছে অবিবাহিত তরুণী রয়েছে তারা চরম নিরাপত্তা সংকটে ভুগছেন। পালিয়ে আসা তরুণীদের মধ্যে অধিকাংশেরই কোনও না কোনও আত্মীয় হত্যার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে তারা এমনিতেই শোকের সাগরে ভাসছে। তার উপর লম্পটদের হানা তাদেরকে অসহায় করে তুলেছে।
উখিয়ার বালুখালীতে আশ্রয় নিয়েছেন মিয়ানমারের মংডু থেকে আসা ২ মেয়ের বাবা হামিদুল আজম। বড় মেয়ে জান্নাতুলের বয়স ১৮ এবং ছোট মেয়ে পারুলের বয়স ১৪। জান্নাতুল দেখতে খুবই রূপসী।
হামিদুল বলেন, প্রাণের ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি। বড় মেয়ে জান্নাতের বিয়েও ঠিক হয়েছিলো পার্শ্ববর্তী একটি ছেলের সাথে। আমরা লাম্বার বিল সীমান্ত দিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে প্রবেশ করি। কিন্তু আসার পথে দুজন লোক তাদের বাড়িতে আশ্রয় দেয়ার নামে বলেন-শহরে নিয়ে যাবে। চাকরির সুযোগ করে দেবে। একজন আমার বড় মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। আমি তাতে রাজি হইনি।
অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জানান, লম্পটদের পাশাপাশি কিছু দালালও রয়েছে সুন্দরী মেয়েদের ভাগিয়ে নিতে। অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে দেয়া হচ্ছে বিয়ের প্রস্তাবও। যা আসলে লোক দেখানো।
টেকনাফের ধামনখালীতে আশ্রয় নিয়েছেন নুরতাজ বেগম ও তার ১৬ বছর বয়সী মেয়ে মনোয়ারা।
নুরতাজ বলেন, কিছু লোক এসে আমি এবং আমার মেয়েকে নিরাপদে রাখবে বলে অনুরোধ করে। তাকে লোভও দেখাচ্ছে। আমি কিন্তু ভয় পেয়েছি।
উখিয়া টেকনাফের বালুখালী,কুতুপালং,আঞ্জুমানপাড়া, রহমতের বিল, ধামনখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় কোনও কারণ ছাড়া কিছু যুবককে মোবাইল ফোন নিয়ে ছবি তুলতে এবং ভিডিও করতে দেখা গেছে। এদের আচরণ ও গতিবিধি যথেষ্ট সন্দেহজনক।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সংখ্যা খুব অপ্রতুল হওয়ায় নিরাপত্তার সংকট বিরাজ করছে।
তবে বর্তমানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেকটা পাল্টে যাবে বলে মনে করেন সচেতন মহল। নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন বাড়ানোর পাশাপাশি নজরদারিও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল। সূত্র : পূর্বপশ্চিম বিডি