January 14, 2025, 12:10 am

সংবাদ শিরোনাম

সড়ক নির্মাণে বন আইনের তোয়াক্কা নেই এলজিইডির

সড়ক নির্মাণে বন আইনের তোয়াক্কা নেই এলজিইডির

ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ফলে নষ্ট হচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকার জীববৈচিত্র্য। বন আইন অনুযায়ী বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে এলজিইডি। এ পরিস্থিতিতে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস করে সড়ক নির্মাণের বিষয়ে সম্প্রতি এলজিইডিকে চিঠি দিয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে সড়ক হচ্ছে। যদিও আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত বনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণের নিয়ম নেই। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে এলজিইডিকে। তবে এলজিইডির দাবি- অনুমোদন নিয়েই বনের ভেতর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। বন অধিদফতর এবং এলজিইডি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এলজিইডি সংরক্ষিত বনের গাছ নিধন, পাথর ও টিলা কেটে কক্সবাজারের টেকনাফ-শাপলাপুর সড়ক নির্মাণ করেছে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, জাহাজপুরা এলাকার গর্জনবাগানের মধ্য দিয়ে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে টেকনাফ-শাপলাপুর ৩১ দশমিক ৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ শুরু করে এলজিইডি। তাতে দাতা সংস্থা জাইকা অর্থায়ন করে। কোনো নকশা ছাড়াই কাজ করায় বাধা দেয় বন বিভাগ, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। আর নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয় পার্শ্ববর্তী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাথর ও টিলার মাটি। গর্জনবাগানের মধ্য দিয়ে সড়ক নির্মাণ করায় কক্সবাজার বন আদালতে এলজিইডির প্রকৌশলী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা করেন শীলখালী বিট কর্মকর্তা। একইভাবে বান্দরবানেও সংরক্ষিত বনের মধ্য দিয়ে সড়ক নির্মাণ করেছে এলজিইডি। সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে বন বিভাগ ও এলজিইডির দ্বন্দ্বের কারণে ৩ বছর বন্ধ ছিল আলীকদম-জানালী পাড়ার পোয়ামুহুড়ি সড়কের নির্মাণকাজ। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নির্মাণাধীন সড়কটির বাবুপাড়া পয়েন্ট থেকে ৩ কিলোমিটারের মধ্যে ৯টি আরসিসি গার্ডার সেতু ও ৫ কিলোমিটার এইচবিবি সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, বন বিভাগকে না জানিয়ে এলজিইডি সড়ক তৈরি করছে। যদিও বন কেটে সড়ক তৈরি করলে পরিবেশগত কী প্রভাব পড়বে, এ বিষয়ে কোনো সমীক্ষা করা হয়নি। এলজিইডির পরিকল্পনা অনুযায়ী সড়ক নির্মাণের কারণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মাতামুহুরী সংরক্ষিত বন। কারণ সড়ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বনে জনবসতি বাড়বে। তার বিরূপ প্রভাব পড়বে আদিবাসীদের ওপর।

সূত্র জানায়,বান্দরবানের মাতামুহুরী ও সাঙ্গু নদীর উপত্যকায় ১৮৭০-এর দশকে ব্রিটিশ সরকার ১ লাখ ৮৪ হাজার একর উপগ্রীষ্মম-লীয় চিরহরিৎ প্রাকৃতিক বনকে সংরক্ষিত ঘোষণা করে। তার মধ্যে আলীকদমের মাতামুহুরী নদীর উপত্যকায় ১ লাখ ২ হাজার একর ও সাঙ্গুর উপত্যকায় ৮২ হাজার একর বনাঞ্চল রয়েছে। ২ হাজার একর সৃজিত বন ছাড়া পুরো বনই প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে। একইভাবে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার সমুদ্র উপকূলের চর কুকরিমুকরি ইউনিয়নের সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়েই সড়ক তৈরি করেছে এলজিইডি। বনের মাটি নিয়েই রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। সড়কটি তৈরি করতে গিয়ে ইতিমধ্যে ওই বনের ২০ হাজার গাছ অনুমতি ছাড়াই কেটে ফেলা হয়েছে। বনের মাটি কেটে নেয়ায় সড়কের পাশের গাছও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। চর কুকরিমুকরির বন বিভাগের টাওয়ার থেকে শুরু হয়ে বনের ভেতর দিয়ে কচ্ছপিয়া নদীর দিকে ১২ ফুট প্রশস্ত ও প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ করা হয়েছে সড়কটি। ১৯৭৭ সালে চর কুকরিমুকরিতে বনায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ওই বনে কেওড়া, সুন্দরি, বাইন, গেওয়া, কাঁকড়া, হেতাল ও পশুরজাতীয় শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) উদ্ভিদ রয়েছে। সেখানে রয়েছে হরিণ, বানর, বন্য মহিষ-গরু, উদবিড়াল, বনবিড়াল, বনমোরগ, সাপ, শিয়াল ইত্যাদি বন্যপ্রাণী। কুকরিমুকরি চরে বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ ৮ হাজার ৫৬৫ হেক্টর। তার মধ্যে বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম রয়েছে ২১৭ হেক্টর। জনবসতি ও কৃষি আবাদ আছে প্রায় ৪ হাজার ৮১০ হেক্টর। সেখানে প্রায় ১৫ হাজার মানুষের বাস। মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন ওই চরের অবস্থান বঙ্গোপসাগরের মোহনায়।

এদিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে যেসব সড়ক গেছে, সেগুলো নির্মাণের আগেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন এলজিইডির পরিকল্পনা বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। যদিও বন অধিদপ্তর বলছে, এলজিইডি এ সংক্রান্ত কোনো অনুমোদন কখনই নেয়নি।

এ প্রসঙ্গে বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের সহকারী বন সংরক্ষক আবু নাসের মহসিন হোসেন জানান, মাঠপর্যায়ে দেখা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সড়ক হচ্ছে। তবে সুন্দরবন এখন পর্যন্ত অক্ষত রয়েছে, কারণ সেখানে কোনো ধরনের অবকাঠামো নেই। কিন্তু যেখানেই অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে, সেখানেই বন ধ্বংস হয়েছে, নষ্ট হয়েছে জীববৈচিত্র্য। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এমন কিছুই করা যাবে না, যাতে লোকসমাগম হয়। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নও দরকার নেই। সেখানে মানুষ নিয়ন্ত্রিত নিয়মে চলাফেরা করবে এটাই নিয়ম। সারা বিশ্বে এমনই হয়।

একই প্রসঙ্গে এলজিইডির সহকারী প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব ইমাম মোরশেদ জানান, এলজিইডি বন ধ্বংস করে সড়ক করছে এমন নয়। তবে যেখানে লোকসমাগম রয়েছে বা চলাচল উপযোগী পথ সৃষ্টি হয়, সেখানে পাকা সড়ক করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় এমপি ও জনপ্রতিনিধিদের মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়।

Share Button

     এ জাতীয় আরো খবর