রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ প্রয়োজনে এক বেলা খেয়েও নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবে, কিন্তু এই শরণার্থীদের যে ফিরিয়ে নিতে হবে, সে কথা মিয়ানমারকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে নিউ ইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেন, মিয়ানমারকে আমরা বলেছি, আপনাদের নাগরিক, তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাদেরকে নিরাপদ রাখতে হবে। তাদের আশ্রয় দিতে হবে। তাদের ওপর জুলুম অত্যাচার চলবে না। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৪ অগাস্ট রাতে আড়াই ডজন পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে হামলার পর দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের গ্রামে গ্রামে নতুন করে দমন অভিযানে নামে; সীমান্তে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের ঢল। কয়েক যুগ ধরে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করে আসা বাংলাদেশের এই দফায় আরও প্রায় চার লাখের বেশি শরণার্থী প্রবেশ করেছে। রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই সংখ্যা ১০ লাখে ঠেকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামি ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে তার ভাষণে রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণগুলো তুলে ধরে তা নিরসনে বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরবেন বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। জাতিসংঘ অধিবেশন উপলক্ষে নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত শেখ হাসিনা গত দুদিন ধরে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনায় মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। ম্যানহাটনের ম্যারিয়ট হোটেলে প্রবাসীদের বাংলাদেশিদের আয়োজনে জনাকীর্ণ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, তাদের (মিয়ানমার) ওপর যেন চাপ সৃষ্টি হয়। তাদের নাগরিক তারা ফেরত নিয়ে যাবে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে। সেটাই আমরা চাই। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি গত মঙ্গলবার বলেছেন, নব্বইয়ের দশকে করা প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে থাকা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে তার দেশ প্রস্তুত। কিন্তু এই শরণার্থীদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে স্বীকার করে না নেওয়ায় এবং তাদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বিষয়টি ভাষণে এড়িয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি সমালোচিত হচ্ছেন। শেখ হাসিনা বলেন, আজকে দুর্ভাগ্য যে, মিয়ানমারে যে ঘটনা ঘটেছে, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, মেয়েদেরকে ধর্ষণ করাৃ এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি যেখানে সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে দলে দলে মানুষ এসেছেৃ আমরা কী করব? মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিতে হয়েছে। কক্সবাজারে গিয়ে নিজের চোখে রোহিঙ্গাদের এই দুর্দশা দেখে আসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি সেখানে গিয়েছিলাম। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার কেবল নিজেদের কথা মনে হয়েছে। আমরাও তো একদিন এইভাবে ওই হানাদার পাকিস্তানিদের কারণে এ ঘর থেকে ওঘরেৃ আমাদের আশ্রয় খুঁজে বেড়াতে হয়েছে। আমাদের ঘড়বাড়ি সব জ¦ালিয়ে ছাড়খার করেছে। সমগ্র বাংলাদেশে আমাদের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ জণগণ, তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে। মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমাদের দেশের মানুষও তো আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ছিল। আজকে যখন তারা বিপদে পড়েছে, অবশ্যই তাদের জায়গা দিতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, অনেকেই প্রশ্ন করেছে, এত মানুষের খাবার দেবেন কীভাবে? আমি তাদের একটা কথাই বলেছি; ১৬ কোটি মানুষ আমাদের। এই ১৬ কোটি মানুষকে যদি খাবার দিতে পারি তাহলে এই সাত-আট লাখকে খাবার দিতে পারব না? বাংলাদেশের মানুষকে ‘অনেক উদার’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে তারা একবেলা খাবে। অন্যবেলার খাবার এই আশ্রিত মানুষকে তুলে দেবে সেই মানসিকতা তাদের আছে। আমরা সেখানে লঙ্গরখানা খুলে দিয়েছি, চিকিৎসা, থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কিন্তু মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতেই হবে, জোরের সঙ্গে বলেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, কোনো দেশে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটুক, তা বাংলাদেশ চায় না। বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে প্রতিবেশী কোনো দেশে কাউকে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাতে দেওয়া হবে না- সরকার তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই। দেশের মানুষের কল্যাণ চাই। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন আমরা করতে চাই। কাজেই সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ সমুন্নত রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করাৃ আমরা সেই ব্যবস্থা নিতে চাই। রোহিঙ্গা বিষয়ে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আজকে জাতিসংঘে যাদের সঙ্গেই দেখা হচ্ছে, প্রত্যেকেই কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ সচেতন। গত মঙ্গলবারই জাতিসংঘে ওআইসির এক বৈঠকে আমি প্রশ্ন রেখেছি, আজকে মুসলমানরা কেন রিফিউজি হয়ে ঘুরে বেড়ায়? আপনারা সকলে কেন এক হন না? কেন সকলে ঐক্যবদ্ধ হন না? যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে দেশের বিভিন্ন খাতের আগ্রগতির কথা তুলে ধরেন এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের নানা কর্মকা-ের সমালোচনা করেন। আমরা দেশের উন্নতি চাই। আর তারা মানুষকে পুড়িয়ে মারে। ধংস্বাত্মক কাজ ছাড়া তারা আর কিছুই করতে পারে না। দলীয় নেতাকর্মীদের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের তাগিদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, আমি আমার এমপিদেরও বলেছি, আপনারা দেখেন, শেখেন। কীভাবে ভোটারের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করা যায়। ওই বড় বড় গাড়ি-বাড়ি হলেই ভোটাররা ভোট দেবে না। ভোটারের সমস্যা জানতে হবে। সেগুলোর সমাধান করতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদেরকে আপনজন ভাবতে হবে। আগামীতে নির্বাচন। এই ইলেকশনটা বিরাট চ্যালেঞ্জ, এটা মনে রাখতে হবে।
নারীদের হিসাবের বাইরে থাকা শ্রমের স্বীকৃতি দিতে হবে: নারীদেরকে সমাজ পরিবর্তনের ‘গুরুত্বপূর্ণ চালক’ অভিহিত করে হিসাবের বাইরে থাকা নারী শ্রমের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে নারীর ক্ষমতায়নের ওপর সংস্থাটির মহাসচিবের উচ্চ পর্যায়ের এক প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে একথা বলেন তিনি। ‘কাউকে পেছনে না রেখে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ শিরোনামে মঙ্গলবারের ওই গোলটেবিল আলোচনায় শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র ও তার সরকারের দেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শিক্ষা, যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সমান সুযোগে অংশ নেওয়ায় নারীকে আমাদের সমর্থন দেওয়া দরকার বলে আমরা বিশ্বাস করি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায়ের সব স্তরে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে। নারী ক্ষমতায়নে সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য-এসডিজি অর্জনে সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এতে আমরা নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত করায় অগ্রাধিকার দিয়েছি। বাংলাদেশের নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রে নিয়ে আসায় বিচার ও নির্বাহী প্রশাসন, বেসামরিক ও সামরিক খাত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের সব চাকরিতে ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষকদের ৬০ শতাংশ নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার পাশাপাশি কর্মজীবী নারীদের সবেতনে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়ার কথাও জানান তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জামানত ছাড়া ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সরবরাহ করছে। নারীদের বিভিন্ন কাজে দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারপরও বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় হিসাবের বাইরে থাকা নারী শ্রমের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। নারী শ্রমিকদের জন্য আরও সুবিধা তৈরির পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি দূর করা প্রয়োজন।
‘পরিবেশ প্রশ্নে সুবিচার’র বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে হবে: বৈশ্বিক পরিবেশ চুক্তির প্রয়োজনে শক্তিশালী ও কার্যকর আইনি ক্ষেত্র প্রস্তুত করার ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এজন্য ‘পরিবেশ প্রশ্নে সুবিচার’র (ক্লাইমেট জাস্টিস) বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে হবে। নিউ ইয়র্কের স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘বৈশ্বিক পরিবেশ চুক্তি’র ওপর এক সম্মেলনে একথা বলেন তিনি। জাতিসংঘের ৭২তম অধিবেশনের সাইডলাইনে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টি ইমানুয়েল ম্যাক্রো। ব্যাপকভাবে শান্তি, স্থায়ীত্ব ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এবং সমাজে বৈষম্য চিহ্নিতকরণে সম্মেলনের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পরিবেশের ওপর বৈশ্বিক চুক্তি করতে বেশ কিছু বিষয়ে নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি। এর মধ্যে পরিবেশ প্রশ্নে সুবিচার এবং শক্তিশালী ও কার্যকর আইনি ক্ষেত্র প্রস্তুতে অগ্রাধিকারের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার ঐতিহাসিক দায়িত্বটি রয়েছে প্রথমেই। জলবায়ু পরিবর্তনে নাজুক দেশগুলোর দিকে সুনির্দিষ্টভাবে নজর দেওয়াসহ এর সঙ্গে খাপ-খাওয়ানো এবং ক্ষতি প্রশমনে নেওয়া প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাস্তবায়নে স্থানীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে কাজ করা অংশীজনদের চিহ্নিত করার ওপরও জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে প্রথম বাংলাদেশে জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল গঠনের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ওই তহবিলে নিজেদের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশ প্রতি বছর তার জিডিপির ১ শতাংশ ব্যয় করছে বলেও জানান শেখ হাসিনা।