নিজস্ব প্রতিবেদক:
আশির দশকের এই জ্যোতিষী ও গণকের নাম ছিল শহীদুল আলম সিকদার দুলু। নাম পরিবর্তন করে হয়েছেন শহীদ আল বোখারী মহাজাতক। মাথায় নেপালি টুপি,বড় মোচ ও সাদা আলখেল্লা পরিহিত এক অকাল্ট পাহাড়ি সাধক। নিজেকে যুগসংস্কারক, ধর্ম প্রচারক ও আধ্যাত্মিক ডিজিটাল গুরু পরিচয়ে দানের টাকা গ্রহণ করছেন। মহাজাতকের পাশাপশি তার স্ত্রী আফতাবুন্নেছা অরুনা নাম পরিবর্তন করে হয়েছেন মা’জি নাহার আল বুখারী।
গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ-বিদেশ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে তাদের হাতে জমা হয়েছে শতকোটি টাকা। দানের এই অর্থ দিয়ে বান্দরবানের লামায় গড়ে তুলেছেন বিশাল সাম্রাজ্য।
জমি কেনার ইতিহাস এবং প্রতারণা
২০০০ সালে মিথ্যা তথ্য দিয়ে পাহাড়ে জমি কেনা শুরু করেন বোখারী। ধর্ম প্রচারের নামে সেখানে যাতায়াত শুরু করলেও কার্যত তার কর্মকাণ্ডে ধর্মের ছিটেফোঁটাও নেই। কাগজে-কলমে তিনি পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও মূলত রাজধানীতে থাকেন। বান্দরবানে ৬ হাজার একর জমি কেনার পাশাপাশি জোর-জবরদস্তি করে আরও ২ হাজার একর জমি দখল করেছেন বলে অভিযোগ। এ জমি দখলের শিকার হয়েছেন স্থানীয় আদিবাসী ম্রো সম্প্রদায় এবং বাঙালি অধিবাসীরা।
বিশাল সম্পত্তির উৎস
শহীদ আল বোখারীর হাতে জমি ছাড়াও দেশে-বিদেশে নামি-বেনামি বিশাল সম্পদ রয়েছে। রাজধানীর শান্তিনগরে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয় থেকে দানের টাকা সংগ্রহ করা হয়। স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, তিনি দেশের বিভিন্ন জেলায় অসংখ্য সম্পত্তির মালিক। তবে তার আয়কর ফাইলে সম্পত্তির উল্লেখযোগ্য কোনো হিসাব নেই।
শহীদ আল বোখারীর পরিচালিত মেডিটেশন কোর্স প্রতিবার ১১,৫০০ টাকা ফি নিয়ে ২০টি কোর্স পরিচালনা করে। এই কোর্স থেকে অর্জিত কোটি কোটি টাকার আয় সরকারের কাছে গোপন রাখা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, মেডিটেশনের আড়ালে মানুষকে হিপনোটাইজ করে দাসে রূপান্তরিত করা হয়।
প্রশাসনের অবস্থান
বান্দরবান জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, বোখারীর বিপুল সম্পদ ও জমি কেনার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে এখনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে।
প্রভাশালীদের যাতায়াত রয়েছে আশ্রমে
আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম , সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, দেশের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রথম নারী শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ঘনঘন যাতায়াত ছিল মহাজাতকের লামার কেয়াজুপাড়ার আস্তানায়। এছাড়াও আওয়ামী লীগের সাবেক প্রভাবশালী নেতাকর্মী , স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়াসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল মহাজাতকের খানকায়।
এলাকাবাসী জানায়, সাবেক সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর উশৈ সিং ব্যতিত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অনেক জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাশালী ব্যক্তিবর্গসহ মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মসহ বিভিন্ন ধর্মের লোকজনের যাতায়াত রয়েছে তার কাছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রবেশাধিকারদের কোনো অনুমতি নেই এখানে ।
জমি ক্রয় ও জবরদখল
২০০০ সালের ০৩ অক্টোবর মিথ্যা ও জাল তথ্য প্রদান করে বান্দরবান সদর উপজেলার ৩১৩ নং মৌজায় ৮৭৩ নং হোল্ডিং এ কাশেমপাড়ায় ১০ শতক জমি ক্রয় করেন আব্দুল মান্নান সিকদারের ছেলে শহীদ আল বোখারী। জমির দাম দেখানো হয়েছে মাত্র ৫ হাজার টাকা। তিনি তখন নিজেকে বান্দরবানের পৌর এলাকার বাসিন্দা দেখিয়েছেন। বান্দরবান পৌরসভার তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান কর্তৃত জাল সনদ ও সংগ্রহ করেন। এ প্রত্যয়ন পত্রের বলে পার্বত্য চট্রগ্রামের শাসনবিধি ১৯০০এর ৩৪(৪) বিধিমতে বিক্রয় সূত্রে নামজারীর অনুমোদন দেয় তৎকালীন জেলা প্রশাসক। জমি ক্রয়ের আবেদনে যে স্বাক্ষর করেছেন সেটিও শহীদ আল বোখারীর নয়। এমন প্রমাণ রয়েছে নিখাদ খবরের হাতে।
এরপর থেকেই তিনি নিজেকে বান্দরবানের স্থায়ী বাসিন্দা দেখিয়ে কয়েক হাজার একর জমি ক্রয় ও দখল করেন। বান্দরানের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও স্বাধীনতার পর থেকে এখনো পর্যন্ত তিনি রাজধানীতেই বসবাস করে আসছেন।
প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী বান্দরবানে জমির পরিমাণ ৬ হাজার একর
জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং হেডম্যানদের নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, বান্দরবানের লামা উপজেলার ৫নং সরই ইউনিয়নের ৩০৩ ডলুছড়ি মৌজায় শহীদ আল বোখারীর নামে ২৮৬৪ একর জমি । ১নং গজালিয়া ইউনিয়নের ৩০০ নং বড়বমু মৌজায় রেজিষ্ট্রিকৃত জমি রয়েছে ১৫৫ একর। বান্দরবান সদর উপজেলার রাজবিলা মৌজায় রয়েছে ১৫৮ একর জমি। এ ছাড়া তার স্ত্রী মা’জি নাহার আল বোখারী,পাহাড়ী অনুসারী থোয়াই অং চাক, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, কোয়ান্টাম মম, ও কসমো স্কুল এন্ড কলেজের নামে রয়েছে আরও ৩ হাজার একর জমি।
দখলে আছে আরও ২ হাজার একর জমি
শুধু বান্দরবানে ৬ হাজার একর জমি ক্রয় করার পর আরও ২ হাজার একর জমি জবর-দখল করেছেন বোখারী। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জানা যায়, নির্যাতন ও নানাভাবে হয়রানি করে শহীদ আল বোখারী কেবল লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রি লিমিটেড এর ৫০০ একর এবং স্থানীয় পাহাড়ী ও বাঙ্গালীদের আরও দেড় হাজার একর জমি জবর দখল করে নিয়েছেন। জমি দখলের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়েছে আদালতে। কিন্তু জমির দখল না ছেড়ে দিনের পর দিন তার বেতনভুক্ত সন্ত্রাসীদের দিয়ে অভিযুক্তদের নানাভাবে হয়রানি করে আসছেন।
(দ্বিতীয় পর্ব আসছে)