মুমিনুলের সেঞ্চুরিতে স্বস্তি
ডিটেকটিভ স্পোর্টস ডেস্ক
লোকে হয়তো শেষটাই মনে রাখবে। তাইজুল ইসলাম ও নাঈম হাসান যা দেখালেন, তা মনে রাখার মতোই বটে! প্রথম দিনের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হতে পারত মুমিনুল হকের আরও একটি সেঞ্চুরি। কিংবা শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের তিন ওভারের তা-ব। কিন্তু তাইজুল ও নাঈমের বীরোচিত প্রতিরোধ ছাপিয়ে যাচ্ছে সবকিছুকেই। মুমিনুলের সেঞ্চুরির পর হঠাৎ এলোমেলো বাংলাদেশ গুছিয়ে উঠেছে শেষ বিকেলের উজ্জ্বল জুটিতে।
প্রথম দুই সেশনে দাপট দেখানো বাংলাদেশ ভেঙে পড়েছিল শেষ সেশনে। কিন্তু দলকে গুঁড়িয়ে যেতে দেননি তাইজুল ও নাঈম। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিন শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের রান ৮ উইকেটে ৩১৫।
স্কোরকার্ড দেখে প্রথম দিনে কোনো এক দলকে এগিয়ে রাখা কঠিন। তবে শেষের স্বস্তি নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের। সপ্তম উইকেট যখন পড়েছিল, দিনের খেলার তখনও ঘণ্টা দুয়েক বাকি। তিনশ কোন সুদূরের পথ! অথচ বাংলাদেশ ঠিকই কাটিয়ে দিয়েছেন দিন, পেরিয়ে গেছে তিনশ।
অফ স্পিনার হিসেবে দলে আসা নাঈম অভিষেকের দিনটিতে দলকে উপহার দিয়েছেন ব্যাটিং বিস্ময়। ঘরোয়া ক্রিকেটে টুকটাক ব্যাটিং সামর্থ্যরে প্রমাণ দিয়েছেন। তবে টেস্ট অভিষেকে চমকে দিয়েছেন ক্যারিবিয়ান পেসারদের গতির সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই আর পরিণত ব্যাটিং দিয়ে। আরেক স্পিনার তাইজুলের ব্যাটিংও যেমন সতীর্থ ব্যাটসম্যানদের জন্য হয়ে থাকল শিক্ষা। প্রথম দিনে থেকেই টার্ন মিলছে উইকেটে, শেষের রানগুলো তাই মহামূল্য হয়ে উঠতে পারে ম্যাচের প্রেক্ষাপটে।
এই জুটির আগে দিনজুড়ে দেখা গেছে টেস্ট ক্রিকেটের নানা রঙ। সংশয় কাটিয়ে টস করতে নামেন সাকিব আল হাসান। এক পেসার আর চার স্পিনারের বাংলাদেশ পায় আগে ব্যাটিংয়ের কাক্সিক্ষত সুযোগ। কিন্তু শুরুটা হলো হতাশায় মাখা। দলে ফেরা সৌম্য সরকার ফিরলেন ম্যাচের প্রথম ওভারেই।
বিপদ আরও বাড়তে পারত, যদি কেমার রোচের বলে ৩ রানে ইমরুল কায়েসের সহজ ক্যাচ দ্বিতীয় স্লিপে না ফেলতেন রোস্টন চেইস। উইকেট প্রত্যাশিতভাবেই মন্থর, প্রথম ঘণ্টায়ই বেশ কয়েক বার বল কিপারের গ্লাভসে গিয়েছে দুই ড্রপে। রোচ ও গ্যাব্রিয়েলের গতি এরপরও ভুগিয়েছে ইমরুলকে।
মুমিনুল অবশ্য শুরু থেকেই ছিলেন সাবলীল। গত টেস্টেই খেলেছেন ১৬১ রানের ইনিংস। এই মাঠে নিজের সবশেষ দুই ইনিংসেও করেছিলেন সেঞ্চুরি। তার ব্যাটিংয়ে ছিল সেই আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া।
ইমরুল রক্ষা পেয়েছেন আরও একবার, জোমেল ওয়ারিক্যানের প্রথম ওভারেই স্লগ করে ক্যাচ দিয়েছিলেন মিড উইকেটে। কিন্তু টিভি রিপ্লেতে দেখা যায় বাঁহাতি স্পিনার করেছিলেন নো বল।
টিকে যান ইমরুল, ছুটতে থাকেন মুমিনুল। লাঞ্চের আগেই দল পেয়ে যায় শতরান। ইমরুলের ব্যাট থেকে যখন মনে হচ্ছিল সরে গেছে বিপদের ছায়া, তখন নিজেই ডেকে আনলেন পতন। ওয়ারিক্যানের নির্বিষ এক বলে শর্ট লেগে ক্যাচ দিলেন ৪৪ রানে। ১০৫ রানের জুটি ভাঙতেই এল লাঞ্চের ঘোষণা।
তৃতীয় উইকেটে মুমিনুলের সঙ্গে মিঠুনের জুটি জাগিয়েছিল বড় কিছুর সম্ভাবনা। দিনের সম্ভবত সবচেয়ে বাজে শটে সেই সম্ভাবনা শেষ করেছেন মিঠুন। লেগ স্পিনার দেবেন্দ্র বিশুকে তেঁড়েফুড়ে মারতে গিয়ে আউট ২০ রানে।
বাংলাদেশ খেলার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নেয় পরের জুটিতে। মাত্র চার সেশনের অনুশীলনে টেস্টে নামা সাকিবের ব্যাটিংয়ে একটুও দেখা গেল না মরচে। ৬৭ রানে জীবন পেয়ে মুমিনুল আরও অপ্রতিরোধ্য। ৯২ থেকে বিশুকে ছক্কায় ৯৮। সেখান থেকে চেইসকে বাউন্ডারিতে সেঞ্চুরি।
এই মাঠে এটি তার টানা তৃতীয় আর আট টেস্টে ষষ্ঠ সেঞ্চুরি। বছরের চতুর্থ সেঞ্চুরিতে ছুঁলেন এই বছরের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরিয়ান বিরাট কোহলিকে। বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে করলেন এক বছরে চার সেঞ্চুরি। অষ্টম সেঞ্চুরিতে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ডে স্পর্শ করলেন তামিম ইকবালকে।
এই জুটি যখন জমাট, ছোবল দিলেন গ্যাব্রিয়েল। প্রথম ১১ ওভারে ওভারপ্রতি প্রায় চার রান করে দিয়ে ছিলেন উইকেটশূন্য। সেই বোলার ৩ ওভারে কাঁপিয়ে দিলেন বাংলাদেশকে।
১২০ রানে মুমিনুলকে ফিরিয়ে শুরু। দুই বল পরই ভেতরে ঢোকা বলে এলবিডব্লিউ মুশফিকুর রহিম। ভেতরে ঢোকা বলেই গতিতে হার মেনে বোল্ড মাহমুদউল্লাহ। তার পরের ওভারে লেংথ বল স্টাম্পে টেনে আনলেন ৩৪ রান করা সাকিব। ৩ উইকেটে ২২২ রানের দারুণ অবস্থান থেকে ২৩৫ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে টালমাটাল বাংলাদেশ!
শেষের প্রতিরোধের গল্প শুরু সেখান থেকেই। নাঈমকে নিয়ে শুরুতে লড়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ২২ রানে মিরাজ ফেরার পর নাঈম ও তাইজুলের তাক লাগানো প্রদর্শনী।
রোচ-গ্যাব্রিয়েলদের গতির সামনে একটুও ভড়কে যাননি ১৭ বছর বয়সী নাঈম। ব্যাট করেছেন ক্রিজের বেশ বাইরে দাঁড়িয়ে, প্রমাণ রেখেছেন দারুণ টেম্পারামেন্ট ও আঁটসাঁট রক্ষণের। তাইজুলের চোখধাঁধানো কিছু শট তার ব্যাটিং সামর্থ্য চিনিয়েছে নতুন করে।
দুই ওভার আগে দিনের খেলা শেষ হলো আলোকস্বল্পতায়। কিন্তু নবম উইকেটে ৫৬ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে তখন আলোকিত বাংলাদেশের ইনিংস।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৮৮ ওভারে ৩১৫/৮ (ইমরুল ৪৪, সৌম্য ০, মুমিনুল ১২০, মিঠুন ২০, সাকিব ৩৪, মুশফিক ৪, মাহমুদউল্লাহ ৩, মিরাজ ২২, নাঈম ২৪*, তাইজুল ৩২*; রোচ ১৫-২-৫৫-১, গ্যাব্রিয়েল ১৮-২-৬৯-৪, চেইস ১১-০-৪২-০, ওয়ারিক্যান ২১-৬-৬২-২, বিশু ১৫-০-৬০-১, ব্র্যাথওয়েট ৮-১-১৯-০)।