ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান হিজরি সন তথা আরবি তারিখ ও চান্দ্রমাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। যেসব উপাদান মুসলিম উম্মাহকে উজ্জীবিত করে, এর মধ্যে হিজরি সন অন্যতম। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি কালচারে ও মুসলিম জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরি সনের সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব তামাদ্দুনিক ঐতিহ্য সম্পৃক্ত।
মানুষের জীবন সময়ের সমষ্টি। সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে আল্লাহ তায়ালা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন দিন, রাত, মাস, বছর ইত্যাদি। বছরকে আমরা সাল বা সনও বলি। বছর শব্দটির মূল হলো উর্দু বরস, সাল শব্দটি ফারসি এবং সন শব্দটি আরবি; বাংলায় বর্ষ, বত্সর ও অব্দ ব্যবহৃত হয়। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং উহাদের মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বত্সর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ ইহা নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এ সমস্ত নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন। (সুরা ইউনুস, আয়াত: ৫)। ‘আর সূর্য ভ্রমণ করে উহার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, ইহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। এবং চন্দ্রের জন্য আমি নির্দিষ্ট করেছি বিভিন্ন মঞ্জিল; অবশেষে উহা শুষ্ক বক্র পুরোনো খর্জুর শাখার আকার ধারণ করে।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ৩৮-৩৯)।
প্রাচীন আরবে সুনির্দিষ্ট কোনো সন প্রথা প্রচলিত ছিল না। বিশেষ ঘটনার নামে বছরগুলোর নামকরণ করা হতো। যেমন বিদায়ের বছর, অনুমতির বছর, হস্তীর বছর ইত্যাদি। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) যখন খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তখন বহু দূর-দূরান্ত পর্যন্ত নতুন নতুন রাষ্ট্র ও ভূখণ্ড ইসলামি খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রের জরুরি কাগজপত্র ইত্যাদিতে কোনো সন-তারিখ উল্লেখ না থাকায় অসুবিধা হতো। ঐতিহাসিক আল বেরুনি কর্তৃক বিধৃত একটি বিবরণী থেকে জানা যায়, বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) একটি পত্রে উমর (রা.)-এর কাছে অনুযোগ করেন, ‘আপনি আমাদের কাছে যেসব চিঠি পাঠাচ্ছেন, সেগুলোতে কোনো সন–তারিখের উল্লেখ নেই, যার কারণে আমাদের অনেক অসুবিধা হয়।’ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে খলিফা হজরত উমর (রা.) একটি সন চালুর ব্যাপারে সচেষ্ট হন।
প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ আল্লামা শিবলী নোমানী (র.) হিজরি সনের প্রচলন সম্পর্কে তাঁর সুপ্রসিদ্ধ আল ফারূক গ্রন্থে উল্লেখ করেন: হজরত উমর (রা.)-এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনের শাবান মাসে খলিফা উমরের কাছে একটি দাপ্তরিক পত্রের খসড়া পেশ করা হয়, পত্রটিতে মাসের উল্লেখ ছিল; সনের উল্লেখ ছিল না। তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন খলিফা জিজ্ঞাসা করেন, পরবর্তী কোনো সময়ে তা কীভাবে বোঝা যাবে যে, এটি কোন সনে তাঁর সামনে পেশ করা হয়েছিল? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না পেয়ে হজরত উমর (রা.) সাহাবায়ে কেরাম ও অন্য শীর্ষ পর্যায়ের জ্ঞানী-গুণীদের নিয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেন। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা মুতাবিক ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে। হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলী (রা.)। তৎকালে আরবে অনুসৃত প্রথা অনুযায়ী পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামি বর্ষ শুরু (হিজরি সনের শুরু) করার ও জিলহজ মাসকে সর্বশেষ মাস হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন হজরত উসমান (রা.)। (বুখারি ও আবু দাউদ)।
নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষে রবিউল আউয়াল মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের ঘটনা মুসলিম জাতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেদিকে লক্ষ করেই ইসলামি সন প্রবর্তন করা হয়, যাকে ‘হিজরি সন’ বলা হয়। হিজরত মানে ছেড়ে যাওয়া, পরিত্যাগ করা; দেশান্তরি হওয়া ও দেশান্তরি করা। পরিভাষায় হিজরত হলো: ধর্মের জন্য এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে চলে যাওয়া। কামনা-বাসনা বিসর্জন দেওয়া, সংযম অবলম্বন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য পরিত্যাগ করাই হিজরতের অন্তর্নিহিত দর্শন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, যাদুল মাআদ, তারীখুল ইসলাম)।
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকেরা হিজরি সন ব্যবহার করতেন। হিজরি সন চান্দ্রমাস অনুযায়ী হিসাব করা হতো বিধায় প্রতিবছর ১০ বা ১১ দিন এগিয়ে যেত। এভাবে প্রতি তিন বছরে এক মাস এগিয়ে আসত বছর। তখন অর্থনীতির প্রধান খাত ছিল কৃষি। রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস ছিল খাজনা। আর খাজনা আদায়ের উপযুক্ত সময় ছিল ফসল তোলার সময়। কিন্তু হিজরি চান্দ্রবর্ষের শুরু-শেষ সব সময় ফসল তোলার সময়ে হয় না বিধায় খাজনা আদায়ে অসুবিধা হতো। এ সমস্যা সমাধানের জন্য মহামতি আকবর একটি নতুন পঞ্জিকার প্রয়োজন অনুভব করেন এবং পণ্ডিত মোল্লা ফতেহ উল্লাহ সিরাজিকে এই পঞ্জিকা প্রবর্তনের দায়িত্ব দেন। পণ্ডিত ফতেহ উল্লাহ সিরাজি হিজরি সনকে মূল ধরে তত্কালে প্রচলিত সৌর বর্ষের বাংলা মাসগুলোকে ব্যবহার করে এবং সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছরকে প্রথম বছর ধরে একটি পঞ্জিকা প্রবর্তন করেন; যার নাম দেন হিজরি বাংলা সন বা ফসলি সন। কালের বিবর্তনে তা আজ বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ হিসেবে পরিচিত।
হিজরি সন মূলত চান্দ্রবর্ষনির্ভর। চান্দ্রমাস ২৯ ও ৩০ দিনে হয় বিধায় ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে বর্ষ পূর্ণ হয়। সৌর মাস হয় ৩০ ও ৩১ দিনে বছর পূর্ণ হয় ৩৬৫ ও ৩৬৬ দিনে। তাই চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষ সাধারণত বাৎসরিক ১০ দিন বা ১১ দিনের পার্থক্য হয়। বাংলা সন হিজরি সন থেকে উদ্ভূত হলেও এতে সময় বিজ্ঞানের সূত্র রক্ষা করা হয়নি। উল্লেখ্য, সৌদি আরব, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মুসলিম দেশগুলোতে হিজরি চান্দ্রবর্ষের পাশাপাশি হিজরি সৌরবর্ষও ব্যবহৃত হয়। এ দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বিধায় এতে অসুবিধা হয় না, বরং সুবিধা হয়।
সূত্র : প্রথম আলো।