মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খান আতার ভূমিকা নিয়ে আরো নিরীক্ষার প্রস্তাব ১৯ প্রবাসী লেখক–সংগঠকের
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
চলচ্চিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধকালীন বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর বক্তব্যকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছেন ১৯ জন প্রবাসী সাহিত্যিক, লেখক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক। একইসঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী অন্যান্যের নাম উচ্চারণ না করায় গণমাধ্যমে পাঠানো ওই বিবৃতিতে নাট্যনির্দেশক নাসিরউদ্দীনের প্রতি ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন তারা। তার বক্তব্যে সমর্থন দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জনস্বার্থে বা জাতীয় স্বার্থেই নাসিরউদ্দীন ইউসুফ এই আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। তার বক্তব্যকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে বিরোধীরা যেন নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে না পারে সেজন্য সংস্কৃতিকর্মীদের সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানান বিবৃতিদাতারা। তারা বলেন, এ বিতর্ক সঠিক এবং যৌক্তিক দিকে প্রবাহিত করাটা আমাদের সবার দায়িত্ব, যাতে করে ইতিহাসের বিভ্রান্তি না ঘটে। কারণ বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতিকর্মীদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার সত্য উন্মোচন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খান আতার ভূমিকা নিয়ে আরো নিরীক্ষার প্রস্তাব দিয়ে বিবৃতিদাতা লেখক–সংগঠকরা বলেছেন, খান আতার ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হবে রাজাকারদের পুনর্বাসন সমতুল্য। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, এ দেশে রাজাকারদের পুনর্বাসনে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দল পর্যন্ত গঠন করা হয়েছে, যাদের ছায়াতলে প্রতিষ্ঠিত রাজাকারেরা এদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সুতরাং এই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমরা খুবই ভীত। এরা এমন ধারা রাজাকার আর এমন মহাজামাই আদরে পুনর্বাসিত হয়েছেন যে, আজ অবধি একবারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনাতো দূরে থাক– লজ্জায় মাথাটি পর্যন্ত নিচু করেননি কখনো। বরং কেউ কেউ ১৬ ডিসেম্বরের পরে পোশাক পাল্টে স্বাধীনতার পক্ষে বিজয়ের গান ধরেছেন অতি সন্তর্পণে। অথবা নিজের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করেছেন লেখক–সাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, সঙ্গীতশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, অভিনেতা–নাট্যনির্দেশক জামাল উদ্দিন হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা লেখক নূরান নবী, লেখক বেলাল বেগ, মুক্তিযোদ্ধা বিজ্ঞানী ড. জিনাত নবী, লেখক–সাহিত্যিক পূরবী বসু, চিত্রশিল্পী মতলুব আলী এবং অভিনেত্রী রওশন আরা হোসেন। এছাড়া স্বাক্ষরদাতা অন্যান্যের মধ্যে রয়েছেন চিত্রশিল্পী কাজী রকিব, চিত্রকর ও সংগীতশিল্পী মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম, চিত্রশিল্পী খোরশেদ আলম সেলিম, বেতার ভাষ্যকার কৌশিক আহমেদ, অভিনেত্রী লেখিকা লুৎফুন নাহার লতা, চলচ্চিত্রকার এনায়েত করিম বাবুল, সাহিত্যিক– চলচ্চিত্রকার আনোয়ার শাহাদত, অভিনেতা–নাট্যনির্দেশক শামসুল আলম বকুল, আবৃত্তিকার–নাট্যকর্মী ও চিত্রকর মিথুন আহমেদ এবং লেখক সাহিত্যিক কুলদা রায়। সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে অভিবাসীদের এক সাংস্কৃতিক সমাবেশে চলচ্চিত্র নির্মাতা খান আতাউর রহমানকে ‘রাজাকার’ বলে মন্তব্য করেন নাট্যজন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। তার বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয়। ভিডিওটিতে দেখা যায়, উপস্থিত প্রবাসীদের সামনে মাইক্রোফোন হাতে মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন বলছেন, খান আতা অনেক বড় শিল্পী কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি রাজাকার ছিলেন। আমি গৌরব করে বলব, আমি না হলে খান আতা মারা যেতেন একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে। এ বক্তব্যের পর বিভিন্ন মহল থেকে মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীনের সমালোচনা শুরু হয়। তার সমালোচনাকারীদের ভাষ্য, ‘স্বাধীনতার এত বছর পরে মুক্তিযোদ্ধা–রাজাকার বিতর্ক কেন? মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীনের বক্তব্য প্রত্যাখান করে যারা তার সমালোচনা করছেন, প্রবাসী সংস্কৃতজনদের বিবৃতিতে তাদের ‘মিথ্যাচারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এতে বলা হয়, সত্যকে স্বীকার না করে, একে প্রশ্নবিদ্ধ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা মিথ্যাচারীদের এক ধারাল কৌশলমাত্র। তাই মিথ্যাচারীরা প্রথমেই সত্যকে অস্বীকার না করে একে প্রশ্নবিদ্ধ করে। খান আতার প্রতি সহানুভূতিশীলদের ‘স্বাধীনতার এত বছর পর মুক্তিযোদ্ধা–রাজাকার বিতর্ক কেন’ বলে তোলা প্রশ্নকে ‘অযৌক্তিক’ বলছেন বিবৃতিদাতারা। বিবৃতিতে তারা বলেন, আমরা মনে করি স্বাধীনতার বিপক্ষে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ যে কোনো অবস্থানই জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতাসম, এমনকি তা যদি শতবর্ষ পরেও ঘটে। সময়ের প্রয়োজনে যে কোনো বিষয় যে কোনো সময় আলোচনা হতে পারে। তা সে চল্লিশ বছরই পরে হোক বা চারশ বছরই পরে হোক। তবে মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ যদি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে খান আতাউর রহমানকে কটাক্ষ করেন, তবে তাও খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন বিবৃতিদাতারা। এ বিষয়ে বিবৃতিতে তারা বলেন, তার জন্য তাকেও সাধারণের মুখোমুখি করা উচিৎ। তা বলে মূল বিষয়টি পাশ কাটিয়ে নয়। প্রবাসীদের আলোচনা সভায় নাসিরউদ্দীন ইউসুফের বক্তব্যে শুধু খান আতার নাম উঠে আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিবৃতিদাতারা। স্বাধীনতাবিরোধী আরো অনেকের নামই নাসিরউদ্দীন ইউসুফ উচ্চারণ করতে পারতেন বলেও মনে করেন তারা। সব স্বাধীনতাবিরোধীর নাম একে একে জনসমক্ষে আসা উচিত মন্তব্য করে বিবৃতিতে তারা বলেন, কেন তিনি অন্য কোনো নাম উল্লেখ করলেন না। এটাও কি পক্ষান্তরে বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া নয়? রাজাকারের প্রসঙ্গে সত্য উচ্চারণকারী শিল্পীদের কি এমন ভূমিকা সাজে, না শোভা পায়? তবে মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন ইউসুফের মতো অন্য মুক্তিযোদ্ধাদেরও ‘প্রকৃত’ সত্য উচ্চারণের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিদাতারা বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, মুক্তিযোদ্ধারাই জানে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা। সে ঘটনা জনসম্মুখে তুলে ধরা তাদের দায়িত্ব।