কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ
কুড়িগ্রামের উলিপুর থানা চত্বরে বিএনপির দুই পক্ষের হাতাহাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুবদল নেতার মৃত্যুর পর প্রতিপক্ষের একাধিক নেতাকর্মীর দোকানপাট ভাঙচুর ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেছেন বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। এ সময় বাড়ি ঘরে লুটপাট চালানো হয় বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) রাতে উলিপুর শহরের কয়েকটি স্থানে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রেমঘটিত একটি বিষয় নিয়ে উলিপুর থানা চত্বরে মীমাংসায় বসেন উপজেলা বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের কয়েকজন নেতাকর্মী। প্রেমের বিষয় নিয়ে এক কিশোরকে আটকের জেরে দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েন তারা। মীমাংসার বসে বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়।
এতে আশরাফুল আলম নামে উলিপুর পৌর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আশরাফুলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বেশ কিছু নেতাকর্মীরা রাতেই জেলা কৃষকদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবু জাফর সোহেল রানা ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফিরোজ কবির কাজলের বসতবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন।
সোহেল রানার বাড়ি থেকে স্বর্ণালঙ্কারসহ দুটি গরু লুট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া উপজেলা বিএনপির সহ-সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলামের মালিকানাধীন শুভেচ্ছা রেস্টুরেন্টে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।
ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। তবে তার আগেই পুড়ে যায় বাড়ির আসবাবসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। কোনও রকমে প্রাণে বেঁচে যান ফিরোজ কবির কাজলের মা। পরে সেনাবহিনী, পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
আবু জাফর সোহেল রানা বলেন, থানা চত্বরে যে বৈঠক হয়েছে তাতে সামান্য হাতাহাতি হয়েছে। কিন্তু আশরাফুলকে কেউ আঘাত করেনি। বরং তিনি অন্যদের মধ্যে হাতাহাতি থামাতে ভূমিকা রেখেছেন। আমরা থানা থেকে বের হয়ে আসার সময় শুনি আশরাফুল মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।’
প্রেমঘটিত বিষয় নিয়ে থানায় বৈঠকে বসা হয়েছিল। কিন্তু আশরাফুল আমাদের রাজনৈতিক সহকর্মী। তাকে কেউ আঘাত করেনি। একটি পক্ষ নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্য আমাদের ওপর তার মৃত্যুর দায় দিয়ে বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে, লুটপাট ও ভাঙচুর চালিয়েছে। বাড়িতে আমাদের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান থাকেন। তারা কেন লক্ষ্যবন্তু হবেন এটা নোংরামি।’ ঘটনার পর অগ্নিসংযোগ এবং হামলা-ভাঙচুর করেছে।
এদিকে আশরাফুলের মৃত্যুর পর শুক্রবার রাতেই উলিপুর থানায় মামলা করেন তার বাবা আয়নাল হক। জেলা কৃষকদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবু জাফর সোহেল রানা ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফিরোজ কবির কাজল, উপজেলা কৃষকদলের সদস্যসচিব ফাজকুরনীসহ ২০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০-২৫ জনকে আসামি করা হয়।
উপজেলা বিএনপির তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মতলেবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। শুক্রবার বিকালের পর কুড়িগ্রাম শহরে বিএনপি নেতৃবৃন্দের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকেও মামলার আসামি করা হয়েছে। আমার মতো অনেকে ঘটনাস্থলে না থাকলেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে তাদের আসামি করা হয়েছে। সঠিক তদন্ত হলে সত্য বেরিয়ে আসবে।
‘আশরাফুলের মৃত্যুর জন্য কারও দায় থাকলে আইনে তিনি দোষী হবেন। কিন্তু কারও বাড়িতে আগুন দেওয়া অমানবিক। আমাদের সবার মা-বোন ও পরিবার বাড়িতে থাকে। তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ছেলেখেলা করা উচিত নয়।
অরাজনৈতিক বিষয় মীমাংসা করতে গিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় যুবদল নেতার মৃত্যুকে ঘিরে উপজেলা বিএনপিতে দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুবদল নেতার মৃত্যু এবং তৎপরবর্তী অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন রংপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল খালেকের অনুসারীরা। যুবদল নেতার মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হচ্ছে তাদেরকে।
উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, উপজেলার রাজনীতিতে সাবেক জেলা সভাপতি ও বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য তাসভীরুল ইসলাম এবং রংপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল খালেকের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট। আব্দুল খালেক কুড়িগ্রাম-৩ আসন (উলিপুর) থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে এই বিভক্তি দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ সামাজিক কাজেই বিভক্তির প্রতিফলন ঘটছে। শুক্রবারের ঘটনা তারই প্রমাণ।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে তাসভীরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। শুক্রবার ঘটনার সময় তিনি উলিপুরে অবস্থান করছিলেন বলে বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
তার অনুসারী ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান বুলবুল বলেন, ‘আব্দুল খালেকের অনুসারীরা হামলা করে থানা চত্বরে একজনকে মেরে ফেলেছে। কয়েকজন আহত হয়েছে। এ নিয়ে উপজেলায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। আমরা বিশৃঙ্খলা থেকে নেতাকর্মীদের থামিয়েছি। আব্দুল খালেক বহিষ্কৃতদের নিয়ে গ্রুপিং করছেন। এখানে সাবেক সভাপতি তাসভীর ভাইয়ের অনুসারীরা মূল ধারায় রাজনীতি করেন। শুক্রবারের ঘটনার জন্য খালেক ভাইয়ের গ্রুপের কয়েকজন বহিষ্কৃত নেতাকর্মীরাই দায়ী।
বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল খালেক গ্রুপিং কিংবা বহিষ্কৃতদের দলে ভেড়ানোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে জানান, ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।আমি ঢাকায় আছি আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা মিথ্যা ও বানোয়াট। বহিষ্কৃত কাউকে দলে নিয়েছি এটা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। উপজেলা বিএনপির কমিটি অবৈধ। কাজেই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার এখতিয়ার তাদের নেই।