সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্ম এখনও প্রাসঙ্গিক: ইনু
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
বিশ্বজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-সংঘাতের প্রেক্ষাপটে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্ম এখনও প্রাসঙ্গিক বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেছেন, কবি নজরুল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক চিরসজীব প্রতিবাদ। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর উত্তরা ক্লাবে ‘একুশ শতকে নজরুল’ শীর্ষক দুইদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন উদ্বোধন করতে এসে এ কথা বলেন তথ্যমন্ত্রী। সম্মেলনটি আয়োজন করছে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়; সহ-আয়োজক হিসেবে রয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ ও ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ। উদ্বোধনীর বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, আজকে কুসংস্কার, কূপম-ুকতা, সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেরিয়ে এসে আমরা যখন একটি বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের কথা বলছি, তখন কবি নজরুল আরো অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেন কালে কালে। তিনি বাঙালির অমর সঙ্গী। একাত্তরে রণাঙ্গনের এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা নিত্য সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে তার গান ‘কারার ওই লোহার কপাট’, ‘চল চল চল’ গানগুলো ছিল আমাদের নিত্য সঙ্গী। তাই বলি, নজরুল আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জাতির বিকাশে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। আজকের বাংলাদেশের পথ কবি নজরুলের পথ। মৌলবাদীদের আস্ফালনের বিরুদ্ধে সরকার যখন সতর্ক অবস্থানে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে, তখন বাঙালির মননকে ‘সাম্প্রদায়িকতার শেকলমুক্ত’ করতে নজরুলের আদর্শকে লালন ও চর্চার পরামর্শ দেন ইনু। তিনি বলেন, নজরুল প্রকৃত অর্থে পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো অন্যায়-অত্যাচার ও মিথ্যার সাথে আপস করেননি। তিনি মানবতার কবি ছিলেন। তিনি জাত-পাত, শ্রেণি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে ভালোবেসে গেছেন। তার এই চেতনাই অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণের জন্য প্রাসঙ্গিক। এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, কবি নজরুলের মধ্যে যে আন্তর্জাতিক চেতনার স্ফূরণ ঘটেছিল, তা তার সচেতন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সতেজ ছিল। তার এই চেতনাবোধই তাকে দেশোত্তীর্ণ ও কালোত্তীর্ণ করেছে। নজরুল গবেষক এমিরেটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এখন পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের যে আগ্রাসন, আজ থেকে শত বছর পূর্বে নজরুল তার কবিতায় তা প্রকাশ করে গেছেন। ইতিহাস সচেতন এই কবি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সা¤্রাজ্যবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করেছিলেন। নজরুলের মতো প্রতিবাদ তো আর কোনো কবির কবিতায় আজও দেখতে পাই না। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক বরুণ কুমার চক্রবর্তী বলেন, বিমল ভূষণ, সুপ্রভা সরকারসহ অনেক গায়ক-গায়িকা বলতেন ‘কাজীদার কোলে বসে আমরা গান শিখেছি’। অথচ তাদের কাছে নজরুলের গানের স্বরলিপি চাইলে তারা তা দিতে পারেননি। নজরুলের গান এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেগুলো সংগ্রহ করে নির্ভরযোগ্য সংকলন প্রকাশ করা খুব জরুরি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর জাতিগত সন্ত্রাস ও নিপীড়নের ধারাবাহিকতার উদাহরণ টেনে জাতীয় কবির নাতনী খিলখিল কাজী বলেন, আজকে নোবেল পুরস্কারজয়ী কবি রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিশ্চুপ হয়ে আছেন। কিন্তু আজ যদি কবি নজরুল বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি চুপ করে থাকতেন না। তিনি প্রতিবাদ করতেন। নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের এই সদস্য পরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। খিলখিল কাজী বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক। তার কবিতা, গান সমাজ জাগরণের হাতিয়ার। তার আদর্শকে অনুধাবন করতে পারাটা এখন ভীষণ জরুরি। অনুষ্ঠানে ‘একুশ শতকে নজরুল’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘যুগোত্তীর্ণ ও মহাকালের কবি’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নজরুল বিদ্রোহের কবি, চির প্রেমের কবি। তিনি আধুনিকতার কবি, যে আধুনিকতায় বাস্তবতা ও প্রত্যক্ষতার সম্মিলন রয়েছে। তার কবিতায় রোমান্টিসিজম দেখতে পাই, তার তার যাপিত জীবন থেকেই সঞ্চিত হয়েছে। উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ইয়াসমীন আরা লেখার সভাপতিত্বে উদ্বোধনী আয়োজনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক খন্দকার মো. নাসিরউদ্দিন, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বেলা দাস, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান। সম্মেলনে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদী, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কবি ও সাংবাদিক জিয়াদ আলী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক খালেদ হোসাইন, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতি ড. বিশ্বতোষ চৌধুরী, ভারতের রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুব্রত কুমার পাল। ‘একুশ শতকে নজরুল’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আজিজুর রহমান। বুধবার এই আয়োজনের সমাপনী আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।