ধর্ম ও সমাজের নানা সংস্কারের দোহাই দিয়ে নারী নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেবী দুর্গার ‘কুমারী’ রূপের আরাধনায় নারী শক্তি জাগরণের প্রার্থনা করেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুর্গোৎসবের দ্বিতীয় দিনে সারা দেশের রামকৃষ্ণ মিশনগুলোতে ‘কুমারী’ দেবীর আরাধনায় মহাঅষ্টমী তিথি পালিত হয়। এই তিথিতেই ‘শুদ্ধাত্মা’ দেবী দুর্গার প্রতীক হিসেবে কুমারী কন্যাকে মাতৃরূপে অঞ্জলি দেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা, যার নাম কুমারী পূজা।
সাধারণত রামকৃ মিশনগুলোই এ পূজার আয়োজন করে। বেলা ১১টার দিকে কুমারী পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও ম-পে ভক্তদের ভিড় দেখা যায় সকাল থেকেই। এ কুমারী সমগ্র জগতের বাক্যস্বরূপা, বিদ্যাস্বরূপা শাস্ত্রানুযায়ী, অষ্টমী তিথি হলো দুর্গোৎসবের সেই মুহূর্ত, যখন অকল্যাণের প্রতীক মহিষাসুর বধকা- চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। কুমারী পূজার মাহাত্ম্য সম্পর্কে ঢাকা রামকৃ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী ধ্রুবেশানন্দ মহারাজ বলেন, দেবীর কুমারী প্রতীকে আরাধনা মূলত মাতৃরূপে অবস্থিতা সর্বব্যাপী ঈশ্বরেরই আরাধনা।
কুমারীতে মাতৃ জাতির শ্রেষ্ঠ শক্তি-পবিত্রতা, সৃজনী ও পালনী শক্তি, সব কল্যাণী শক্তি সূক্ষ্মরূপে বিরাজিতা। এ কুমারী সমগ্র জগতের বাক্যস্বরূপা, বিদ্যাস্বরূপা। তিনি এক হাতে অভয় ও অন্য হাতে বর দান করেন।
শাস্ত্রানুযায়ী, দুর্গাপূজার অষ্টমী বা নবমীতে সাধারণত ৫ থেকে ৭ বছরের একটি কুমারীকে প্রতিমার পাশে বসিয়ে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়। প্রায় সর্বজাতীয়া কন্যাকে কুমারীরূপে আরাধনা করা গেলেও রামকৃ মিশন ব্রাহ্মণকন্যা ছাড়া পূজা করে না। মিশন অধ্যক্ষ বলেন, স্বত্ত্বগুণসম্পন্না-শান্ত, পবিত্র, সত্যশীলা এসব দৈবী সম্পদের অধিকারিণী কুমারীই জগজ্জননীর প্রতিমারূপে গ্রহণের বিধি রয়েছে। কুমারী পূজার ধ্যানে আছে ‘ভদ্রবিদ্যাপ্রকাশিনীম’।
নারী জাতির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা সমাজ ও জীবনকে মহৎ করে তোলা- কুমারী পূজা এ শিক্ষা দেয় বলে জানান ধ্রুবেশানন্দ। পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরুর সময় ম-পের গাঁদাফুল আর বেলপাতায় আবৃত আসনে নিয়ে আসা হয় এ বছরের ‘কুমারী দেবী’ রূপকথা চক্রবর্তীকে। রূপকথার বয়স সাত, তাই শাস্ত্রানুযায়ী এবারের কুমারী দেবীর নাম ‘মালিনী’।
শুরুতেই গঙ্গাজল ছিটিয়ে কুমারী দেবীকে পরিপূর্ণ শুদ্ধ করে তোলা হয়। এরপর তার পা ধুয়ে নিবেদন করা হয় অর্ঘ্য। কুমারী পূজার ১৬টি উপকরণ দিয়ে শুরু হয় পূজার আচার। এরপর অগ্নি, জল, বস্ত্র, পুষ্প ও বাতাস- এই পাঁচ উপকরণে দেওয়া হয় কুমারী মায়ের পূজা। অর্ঘ্য নিবেদনের পর দেবীর গলায় পরানো হয় পুষ্পমাল্য। পূজা শেষে প্রধান পূজারি আরতি দেন এবং তাকে প্রণাম করেন। সবশেষে মন্ত্রপাঠ করে ভক্তদের প্রসাদ বিতরণের মধ্য দিয়ে বেলা সাড়ে ১১টায় শেষ হয় কুমারী পূজা। রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা বিদ্যুৎ চক্রবর্তী-লিপি চক্রবর্তীর মেয়ে রূপকথা বনশ্রীর চাইল্ড স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে।
পূজার পর সে সাংবাদিকদের বলে, আমি চাই, এ জগতে সবাই যেন অনেক সুখে-শান্তিতে থাকে। আমি দুগ্গা দেবীর কাছে প্রার্থনা করেছি। কথিত আছে, স্বামী বিবেকানন্দ যখন প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেন, তখন তার গুরু রামকৃ একটি কুমারী বালিকাকে শুদ্ধ করে আরাধনা করার কথা বলেছিলেন। সেই থেকে রামকৃ মঠ ও মিশনগুলোতে দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিনে কুমারী পূজা করা হয়। দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলী দিয়ে ভক্তদের সমবেত প্রার্থনা ছিল, দেবী দুর্গা যেন প্রতিটি নারীতেই ‘ঘুমন্ত’ মাতৃশক্তিকে জাগিয়ে তুলেন।
পুরুষতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নারীর এইরূপ জাগরণ হলেই বন্ধ হবে নারীর প্রতি সব অন্যায়। ঢাকার গোপীবাগের রামকৃ মিশনে পূজা করতে আসা টিকাটুলীর বাসিন্দা রতœা সরকার বলেন, আজ আমরা শুদ্ধাত্মা দেবীকে কুমারী রূপে আরাধনা করব। দেবীর কাছে প্রার্থনা করব, তিনি যেন সকল নারীর মধ্যে ঘুমন্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলেন। এই শক্তির জাগরণ হলে একজন নারীও আর নির্যাতিত হবে না। খোদ ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধেই যখন নারী নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তখন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পুণ্যার্থীরা।
অঙ্কিতা চক্রবর্তী বলেন, যাদের কাছে আমরা ন্যায়পরায়ণতা, মূল্যবোধ ইত্যাদি শিখব, তারাই যদি…… তারাই কি না আবার ঈশ্বরের পূজা করেন! যে হাত নারী নির্যাতন করে, সে হাত ধরে যেন মাকে কখনো অঞ্জলি দিতে না হয়, আজ সে প্রার্থনা করেছি। স্কুল ছাত্রী প্রজ্ঞা পারমিতা প্রার্থনা করেছে সমাজে নারীর অবস্থান যেন আরও বেশি ‘দৃঢ় ও সুসংহত’ হয়। সীমা দে বলেন, সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী যখন এগিয়ে চলছে, তখন ধর্ম আর সমাজের নানা সংস্কারের ধোঁয়া তুলে তাদের পিছিয়ে দেওয়া হয়। মায়ের কাছে প্রার্থনা করব, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সব অযৌক্তিক বিধিনিষেধের বেড়াজাল ভেঙ্গে যেন রাষ্ট্রকল্যাণেও নিজেদের নিয়োজিত রাখতে পারি। এদিকে কুমারী পূজা ছাড়াও পূজা ম-প ও মন্দিরগুলোতে গত বুধবার অষ্টমী পূজা হচ্ছে। অষ্টমীতে দেবী দুর্গার চরণে পুষ্পাঞ্জলি, আরাধনা আর দুপুরে ‘মহাপ্রসাদ’ বিতরণ করা হয়।