বেড়েই চলেছে রেলের আয় এবং ব্যয়ের ফারাক
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
লোকসান ঠেকাতে ৫ বছরের ব্যবধানে দুই দফায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়। তাতে আয় কিছুটা বাড়লেও ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ। এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে আয় আরো বাড়িয়ে লোকসান কমানো যায় তা নিয়ে চিন্তায় রেলের নীতিনির্ধারকরা। এ অবস্থায় রেলের বেশির ভাগ প্রকল্পগুলোতে ঋণ দেওয়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) আবারো রেলকে ভাড়া বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। বর্তমানে রেলে নতুন রেলপথ নির্মাণ, কোচ ও ইঞ্জিন কেনায় বরাদ্দ বাড়লেও লোকসান অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। নতুন বেতন কাঠামো চালু হওয়ায় ২০১৫–১৬ অর্থবছর থেকে রেলের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতায় বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আয় বাড়াতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ টিকিট ছাড়া যাত্রী পরিবহন ঠেকাতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণে জরিমানা বাড়ানো, টিকিট ছাড়া রেলস্টেশনে ঢোকা বন্ধ আরো জোরদার করার পরিকল্পনা নিচ্ছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রেলের আয় বাড়াতে প্রাথমিকভাবে দেশের ১০টি রেলস্টেশনে টিকিট ছাড়া যাত্রী পরিবহন বন্ধ করতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। একই সাথে রেলের জমিতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেও আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিতে (পিপিপিতে) হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে দেশে রেলপথ আছে দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার। স্বাধীনতার পর ৩০০ কিলোমিটার শাখা রেলপথ বন্ধ হয়েছিল। এখন নতুন রেলপথ নির্মাণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলছে। ঢাকা–সিরাজগঞ্জ, ঢাকা–রংপুরসহ বিভিন্ন রুটে নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। তবে নতুন ও পুরনো সব ধরনের ট্রেনে বিনা টিকিটে যাত্রী পরিবহন কমেনি। তা রোধ করে রেলের আয় বাড়াতে কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারিও তেমন নেই। ফলে গত অর্থবছরে রেলের আয় হয়েছে এক হাজার ৩০৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ব্যয় হয় দুই হাজার ৫৩২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। একই সময়ে লোকসান ছিল এক হাজার ২২৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা। তার আগের অর্থবছরে (২০১৫–১৬) আয় হয়েছিল এক হাজার ২৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছিল দুই হাজার ২২৯ কোটি ২২ লাখ টাকা। সেবার লোকসান হয়েছিল এক হাজার ২০৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ২০১৪–১৫ অর্থবছরে আয় ছিল ৯৫৬ কোটি ১২ লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৮২৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। লোকসান ছিল ৮৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, আগের চেয়ে রেলের বিভিন্ন পথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাবদ আয় বাড়ছে। যেমন ২০১৬–১৭ অর্থবছরে যাত্রী পরিবহনে রেলের আয় হয়েছিল ৭৮৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং পণ্য পরিবহনে আয়ের পরিমাণ ছিল ২৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ২০১৫–১৬ অর্থবছরে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাবদ সংস্থাটির আয়ে যোগ হয়েছিল যথাক্রমে ৫৯৬ কোটি ৪৩ লাখ ও ১৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। সেক্ষেত্রে আয় আগের চেয়ে বেড়েছে ভাড়ার হার বাড়ানোয়। তাছাড়া বিভিন্ন পথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনও বেড়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকসান কমছে না। উল্টো দিন দিন তা বাড়ছেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বেতন কাঠামো প্রবর্তনের পর থেকে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন ভাতা এত বেড়েছে যে, যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাবদ বেড়ে যাওয়া আয় তার তুলনায় খুবই কম। ১৯৯২ সালের পর টানা দুই দশক রেলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হয়নি। লোকসান কমাতে ১৯৯২ সালে নির্ধারিত ভাড়া ২০ বছর পর ২০১২ সালের ১ অক্টোবর থেকে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে কার্যকর করা হয়েছিল। আর অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল প্রবর্তনে আয়–ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে যাবে যুক্তিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রেলে ভাড়া ৭ থেকে ৯ শতাংশ বাড়ানো হয়। মূলত ২০১৫–১৬ অর্থবছরে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল প্রবর্তনে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা ছাড়াও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসানের আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছিল রেল। নতুন বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ায় ওই সময় বেতন–ভাতা বাবদ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ছাড়াও রক্ষণাবেক্ষণ ও আনুষঙ্গিক কাজে ২০০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে যায়।
সূত্র আরো জানায়, কোনো ধরনের লক্ষ্য ছাড়াই রেলওয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। তাতে রেলে স্বাধীনতার পর প্রতিটি অর্থবছরেই লোকসান হয়েছে। এখন তা বেড়েছে অষ্টম বেতন কাঠামো চালুর ফলে। অপেক্ষাকৃত বেশি লাভ হলেও রেলে পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি রেলের আয় গড়ে ৫৬ পয়সা, ব্যয় এক টাকা ৫২ পয়সা। পণ্য পরিবহনে প্রতি টনে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ২২ পয়সা, আয় দুই টাকার বেশি। কিন্তু পর্যাপ্ত ইঞ্জিনের অভাব, বগি সংকট, পণ্য পরিবহনের দীর্ঘ সময় অপচয়ে পণ্য পরিবহন আশানুরূপ নয়। তাতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহও কমছে। ব্যবসায়ীরা ট্রেন ছেড়ে ট্রাকের ওপর বেশি ভরসা পাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশির ভাগ জেলায় রেলপথ থাকলেও চাল, সবজি ও শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনের জন্য তা ব্যবহার হচ্ছে না।
এদিকে আয়–ব্যয়ের বিপুল ব্যবধান প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন জানান, অষ্টম বেতন কাঠামো চালুর পর থেকেই লোকসান কিভাবে কমানো যায় তার জন্য চাপ রয়েছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগসহ রেলপথ নির্মাণের বড় বড় প্রকল্প নেয়া হয়েছে। রেলে বিনিয়োগ বাড়ছে, তবে তার সুফল পেতে সময় লাগবে। রেলপথ সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ভাড়া আগে একবার বাড়ানো হয়েছিল। তাতে লোকসান কমেনি। এখন বিনা টিকিটে যাত্রী পরিবহন কমিয়ে আনতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তাতে প্রায় ১০ শতাংশ আয় বাড়ানো সম্ভব হবে। আয়ের অন্য উৎসগুলোর দিকেও তদারকি বাড়ানো হবে।