আইন হলেও কমছে না শিশুদের বইয়ের বোঝা
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
সরকার আইন করলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা শিশুদের বইয়ের বোঝা কমানোর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। সরকারি অনুমোদনহীন বই ও শিক্ষা উপকরণ শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানোর বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর পরিপত্র জারি করলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। অভিযোগ উঠেছে, সরকারি সংস্থার দুর্বল অবস্থানের কারণেই স্কুল কর্তৃপক্ষের অমানবিক ও অবৈধ কর্মকান্ড থেকে শিশুরা রক্ষা পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের দাবি- নামকাওয়াস্তে অনুরোধ না করে সরকার যেন শিশুদের ওপর অনুমোদনহীন বইয়ের বোঝা কমানোর জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। গত ১০ অক্টোবরের পরিপত্র জারির পর এখন পর্যন্ত কোন প্রতিষ্ঠানেই শিশুদের বইয়ের বিষয়ে কোন পরিবর্তন আনেনি। অভিভাবক ও শিক্ষা বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজধানীর নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শুরু করে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই শিশুদের বইয়ের বোঝা কমানোর দিকে নজর নেই। বরং ওসব প্রতিষ্ঠানইলাখ লাখ টাকা নিয়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে নিচ্ছে ৫ থেকে ৮টি করে সহায়ক বই। ফলে অনেক শিশুর জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইয়ের থেকে অনুমোদনহীন বইয়ের সংখ্যা বেশি হচ্ছে। আর ইংলিশ মিডিয়ামে তো চলছে রীতিমতো নৈরাজ্য। সরকারী টাকা নেয়া হয় না কিংবা সরকারের কোন নীতিমালা নেই এই ছুঁতো দিয়ে সেখানে অরাজকতা অব্যাহত রয়েছে। যেখানেই অভিভাবকরা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে যাচ্ছেন সেখানেই বলে দেয়া হচ্ছে, সরকার কোন নিয়ম করে দেয়নি যে নতুন কিছু করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উদ্যোগ কতোটুকু সফল হবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
সূত্র জানায়, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিশুদের ওপর অনুমোদনহীন বই চাপায়, ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা না দিলে শিশুরা কোনভাবেই বইয়ের বোঝার সঙ্কট থেকে রক্ষা পাবে না বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও অভিভাবকদের। কারণ ওসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ কোনো অনুরোধই আমলে নিচ্ছে না। মূলত তারা অবৈধ বই বাদ দিয়ে অসাধু প্রকাশনা থেকে নেয়া লাখ লাখ টাকা হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না। প্রতিটি শিশুকেই অতিরিক্ত ২ থেকে ৪টি বই কিনতে হয়। সঙ্গে আছে আরো শিক্ষা উপকরণ, প্রত্যেক বিষয়ের জন্য খাতা, পানির বোতল, খাবারের জন্য বক্সতো আছেই। সব মিলিয়ে বিশাল এক ব্যাগ নিয়ে ক্লাসে আসছে শিশুরা। অনুমোদনহীন বই শিশুদের কিনতে বাধ্য করতে বেসরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে। ওই যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তাদের পকেটে। যদিও বহুদিন ধরেই শিশুদের ঘাড়ে অসংখ্য বইয়ের বোঝা নিয়ে নানামুখী সমালোচনা হচ্ছে। কারণ বিদ্যালয় থেকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে অসংখ্য বই ও শিক্ষা উপকরণ। যার অধিকাংশই সরকার অনুমোদিত না হলেও শিশুদের পড়তে বাধ্য করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর এসব বই পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তির বিনিময়ে শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা নোট-গাইড বইয়ের প্রকাশকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা।
সূত্র আরো জানায়, বছরের পর বছর ধরে শিক্ষার্থী অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের প্রতিবাদ উদ্বেগের পর সরকারি অনুমোদনহীন যে কোন বই ও শিক্ষা উপকরণ শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানোর বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সতর্ক করে পরিপত্র জারি করে। যেখানে অনেকটা অনুরোধের সুরেই বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী শিশুদের জন্য যেসব বই অনুমোদন করেছে তা পরিবহনে কোন ছেলে-মেয়েদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যে সব ছাত্রছাত্রী ব্যাগে বই বহন করে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী এর ওজন যাতে বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি না হয় সে বিষয়ে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।’ এ ব্যাপারে সকলকে সতর্ক করে আদেশ দিলেও কঠোর কোন নিষেধাজ্ঞা না দেয়ায় সরকারের নতুন উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা। যারা শিশুদের ওপর অনুমোদনহীন বই চাপায় সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা না দিলে শিশুরা কোনভাবেই এ সঙ্কট থেকে রক্ষা পাবে না বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
এদিকে শিক্ষাবিদদের মতে, সরকারের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা আরও কঠোরভাবে করলে ভাল হতো। না হয় ভাল কোন ফল হবে না। শিশুদের বাঁচাতে হলে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, বইয়ের বোঝা কমাতে হবে। সেটা কীভাবে হবে তা খুঁজে বের করতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই। স্কুল কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে হবে। অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়া দরকার। তাছাড়াও বিষয়টি বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরালো করতে হবে।
অন্যদিকে চিকিৎসকদের মতে, ৫ বছরের একটি ছেলে শিশুর আদর্শ ওজন ১৮ দশমিক ৭ কেজি, আর মেয়ের ১৭ দশমিক ৭ কেজি। ৬ বছরের একটি ছেলে শিশুর আদর্শ ওজন ২০ দশমিক ৬৯ কেজি, আর মেয়ের ১৯ দশমিক ৯৫ কেজি। সে হিসেবে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন সর্বোচ্চ ২ কেজি হওয়ার কথা (শরীরের ওজনের ১০ শতাংশ)। সেখানে ঢাকার খ্যাতনামা স্কুলগুলোর প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন সর্বনিম্ন চার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ কেজি পর্যন্ত পাওয়া যায়। অন্যান্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও হিসাবটা এরকমই। অথচ প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত বই মাত্র এক থেকে তিনটি। অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগের কারণে শিশুরা মেরুদ- ও হাড়ের বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে বেড়ে উঠছে।
এ প্রসঙ্গে অভিভাবকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভিভাবক সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিপা সুলতানা জানান, সরকার প্রথমবারের মতো এ বিষয়ে সতর্ক করে আদেশ দিয়েছে এটা অবশ্যই ভাল খবর। তবে যারা বই চাপিয়ে দিচ্ছে আমাদের বাচ্চাদের ওপর, সেই কর্তৃপক্ষের মনে যদি ভয় ঢোকানো না হয়, তাহলে ভাল ফল পাওয়া যাবে না। কারণ শিশুরা অনুমোদনহীন বই না এনে পারবে না, যদি তা পাঠ্যক্রমে কর্তৃপক্ষ তা রেখে দেন। তাই এমন আদেশ হতে হবে, যাতে কেউ এসব বই পাঠ্যক্রমেই রাখতে না পারে।