তীব্র গ্যাস সঙ্কট প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন বিঘ্নিত
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
শিল্প জেলা গাজীপুরে শফিপুর, কোনাবাড়িসহ আশপাশ এলাকার শিল্প-কারখানার ভয়াবগ গ্যাস সঙ্কট বিরাজ করছে। গ্যাসের অভাবে গত কয়েকদিন ধরে বেশিরভাগ সময় শিল্পকারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার পণ্য উৎপাদনে চরম বিঘিœত হচ্ছে। তাতে রফতানিমুখী বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। স্থানীয় শিল্পমালিকদের অভিযোগ- কিছুদিন পরপর শিল্পাঞ্চল খ্যাত এ এলাকায় গ্যাসের চাপ কমে যাচ্ছে। গ্যাস সংকট নিয়ে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর উদ্বেগ, চিঠি চালাচালি হলেও নির্বিকার সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়িদের মতে, এ পরিস্থিতি দেশের বিরুদ্ধে এক ধরনের ষড়যন্ত্র। যদিও সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে প্রায় বলা হয়, দেশে শিল্প বিনিয়োগের চমৎকার পরিবেশ বিদ্যমান। একাধিক রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শিল্পমালিকরা অহরহ গ্যাস সঙ্কটকে দেশের শিল্পকারখানা ধ্বংসের একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন। অভিযোগ আছে, মূলত দেশের গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ করে দেয়ার জন্য একটি চক্র কিছুদিন পরপর ইচ্ছাকৃতভাবে গ্যাসের চাপ কমিয়ে দিচ্ছে। তাতে বিদেশি বায়াররা বিরক্ত হয়ে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। স্থানীয় তিতাস গ্যাসের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও এ ব্যাপারে কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না শিল্পমালিকরা। ফলে ফের তীব্র গ্যাস সঙ্কটের কারণে গ্যাসনির্ভর বিভিন্ন শিল্পকারখানায় উৎপাদনে ধস নেমেছে। ওসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে গাজীপুরের বোর্ডবাজার, সাইনবোর্ড, ছয়দানা মালেকের বাড়ি, ভোগড়া, নাওজোড়, কড্ডা, কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, মৌচাক, সফিপুর, রাজেন্দ্রপুর বাংলাবাজার ও ভবানীপুর এলাকায় তীব্র গ্যাস সঙ্কটে কলকারখানায় এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। একই সঙ্গে এসব এলাকার সিএনজি পাম্প ও বাসাবাড়িতেও মারাত্মক গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। ঝুঁকির মুখে পড়েছে গাজীপুরের হাজারও শিল্পকারখানা। শিল্পমালিকদের অভিযোগ- কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে শিল্পকারখানা গড়ে তুললেও তারা এখন গ্যাস সংকটের কারণে লোকসানের মুখে পড়েছেন। তারা বলেছেন, গত মাসে ১৫ দিনের বেশি একনাগাড়ে গ্যাস সংকট ছিল। গত দু’দিন ধরে আবার আগের অসহনীয় অবস্থায় চলে এসেছে। তাদের অভিযোগ- গ্যাসের চাপ না থাকায় একদিকে শিল্পকারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে, অপরদিকে মিটারে ১৫ পিএসআই চাপের বিল গুনতে হচ্ছে। এতে বিপুল অঙ্কের অর্থ লোকসান হচ্ছে। অথচ গাজীপুরের শিল্পকারখানাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা না হলে কয়েক হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। আর তাতে বেকার হয়ে পড়বেন লাখ লাখ শ্রমিক। দেশের রফতানি আয়েও ঘটবে বিশাল ঘাটতি। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন শিল্পকারখানার মালিকরা।
সূত্র জানায়, বর্তমানে গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানায় গ্যাস সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ওসব শিল্পকারখানায় প্রতিদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও এরপর চাপ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। এমন অবস্থা চলতে থাকে রাত ১১টা পর্যন্ত। ফলে মেশিন চালানো যায় না বলে উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়। তখন শ্রমিকদের বসিয়ে রাখতে অথবা ছুটি দিতে হয়। ইতিমধ্যে ব্যাপক গ্যাস সংকটের কারণে শতভাগ রফতানিমুখী গার্মেন্ট কারখানাগুলোয় উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। কাক্সিক্ষত উৎপাদন না হওয়ায় সময় মতো শিপমেন্ট সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে অনেক কারখানা রফতানি অর্ডার বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া উৎপাদন হ্রাস ও রফতানি ব্যাহত হওয়ায় শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছেন মালিকরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, সিলেট গ্যাসফিল্ড, তিতাস গ্যাসক্ষেত্রসহ ১০টি বড় গ্যাসকূপে কয়েকদিন ধরে গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে। দুটি কূপ বন্ধ আছে। ভাঙ্গুরা গ্যাসফিল্ডে আগে উৎপাদন হতো ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস (এমএমসিএফ), সেখানে উৎপাদন হয়েছে ৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট। তাছাড়া রূপগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে ৮ এমএমসিএফডি থেকে কমে উৎপাদন হচ্ছে দশমিক ৪ মিলিয়ন ঘনফুট। সেমুতাং গ্যাসফিল্ডে আগে হতো ৩ এমএমসিএফডি, এখন হচ্ছে দশমিক ৯ এমএমসিএফডি। শাহবাজপুরে আগে হতো ৫০ এমএমসিএফডি, এখন হচ্ছে ৩৭.২ এমএমসিএফডি, ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে আগে ২৬ এমএমসিএফডি হতো, এখন হচ্ছে ১২.০১ এমএমসিএফডি। সালদায় আগে ছিল ১০, এখন হচ্ছে ৩.০৮ এমএমসিএফডি, বিয়ানীগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে আগে হতো ১৫, এখন হচ্ছে ৯.২ এমএমসিএফডি। সিলেট গ্যাসফিল্ডে আগে হতো ৮ এমএমসিএফডি, এখন হচ্ছে ৫ এমএমসিএফডি। তিতাস গ্যাস ফিল্ডে আগে হতো ৫৪২ এমএমসিএফডি, এখন হচ্ছে ৩৩৫ এমএমসিএফডি। এ অবস্থায় গাজীপুরে আবারো তীব্র গ্যাস সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে এমন পরিস্থিতিতে প্রসঙ্গে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান জানান, বর্তমানে সারা দেশে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সংকট চলছে। বেশিরভাগ গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন কমে গেছে। তারপরও তারা রেশনিং করে এতদিন গাজীপুর এলাকায় গ্যাস দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু গত দু’দিন ধরে দুটি গ্যাসকূপ মেরামতের জন্য বন্ধ রাখায় উৎপাদন কমে গেছে। তিতাস গ্যাস কোম্পানি আগে যেখানে ১৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেত, সেখানে এখন তিতাসকে দেয়া হচ্ছে ১৫শ’ থেকে ১৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এ অবস্থায় তাদের পক্ষে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের গ্যাস সংকট সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে ২-৩ দিনের মধ্যে এ সংকট থাকবে না বলেও তিনি জানান।