মো. ইসমাইলুল করিম নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রাকৃতিক রূপ লাবণ্যে ঘেরা পার্বত্য জেলা বান্দরবানের ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে মিল রেখে এই অঞ্চলের কৃষিকাজেও আসে ভিন্নতা।
চলতি আমন মৌসুমে এই অঞ্চলের সমতল এলাকায় ধানের উৎপাদন বেশি হওয়ায় খুশি কৃষক। অগ্রহায়ণের শেষ দিকে এসে নতুন তোলা ধান নিয়ে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন পাহাড়ি জনপদের মানুষেরা। চলছে ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়া ও শুকানোর কাজ।
নতুন ধান তোলা নিয়ে এখন এখানে ঘরে ঘরে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। বান্দরবান সদরের ডলুপাড়া ও রেইচা এলাকা। পাহাড়ের বুকে ফলানো পাকা ধান কেটে, তা ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
সরজমিনে জেলা সদরের রেইসা, গোয়ালিয়াখোলা, ক্যামলংসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাঠজুড়ে পাকা ধান কাটছেন পাহাড়ি নারীরা। তাদের মুখের হাসিই বলে দেয় এই মৌসুমে তারা ভালো ফলন ঘরে তুলছেন।
জেলা সদরের রেইসা এলাকার এক কৃষাণী বলেন, গত বছর এই জমিতে ব্রী-১১ ধান লাগানোর পরেও আশানুরূপ ফলন না পাওয়ায় এ বছর আমন মৌসুমে জমিতে চিকন পাজাম ধান রোপণ করেছি। ধানের উৎপাদন খরচ কম, রোগবালাই কম হওয়ার কারণে এই এলাকার প্রায় সবগুলো জমিতেই পাইজাম ধানের চাষাবাদ হয়েছে বলে তিনি জানান। কৃষক দেলোয়ার জানান, আমন মৌসুমে তার ৪ কানি জমিতে লাগিয়েছেন পাইজাম ধান। ফসল দেখে খুশি তিনি।
বীজতলা তৈরি, মাঠে ধান লাগানো, কাটা, ধান মাড়াই করাসহ প্রতি কানিতে ৪ মাসে ১৪ হাজার টাকা খরচ হবে বলে তিনি আশা করেন। আমার জমিতে প্রতি কানিতে ২০ মণ ধান পাওয়া যাবে। ধান মাড়াইয়ের পর ৫৬০ কেজি চাল পাওয়া যাবে।
.
ভারতীয় পাইজামের বর্তমান সময়ের বাজার মূল্য ৬০ টাকা করে হলে এর বাজার মূল্য ৩৩ হাজার ৬০০ টাকা দাঁড়ায়। সে হিসেবে উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে কৃষকের হাতে লাভ থাকবে ১৯ হাজার ৬শ টাকা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, গতবছর জেলায় ৭৯৩ হেক্টর জমিতে ভারতীয় পাজাম ধানের চাষাবাদ হলেও চলতি ২৪-২৫ আমন আবাদ মৌসুমে জেলায় ১৪৪৫ হেক্টর জমিতে পাইজাম ধানের চাষাবাদ হয়েছে।
অনুকূল আবহাওয়া ও জলবায়ুর কারণে এ বছর আমন মৌসুমে জেলা সদরসহ নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলাসহ ৪টি উপজেলায় ভারতীয় পাইজাম ধানের ব্যাপক ফলন হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১০৫০ হেক্টর, রোয়াংছড়ি উপজেলায় ৫৩.৬ হেক্টর, লামা উপজেলায় ১৮৯ হেক্টর, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ১৫৫ হেক্টর জমিতে এই ধানের তিনটি জাত চাষাবাদ হয়েছে।
উচ্চ ফলনশীল উপশী জাতের ধান পাইজামের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা না হলেও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে উৎপাদন বেশি হওয়ার কারণে এই অঞ্চলের সমতল এলাকার কৃষকদের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে উচ্চ ফলনশীল ধানের এই জাতটি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ এম এম শাহ নেওয়াজ বলেন, আমন আবাদ মৌসুমে এ বছর জেলায় মোট ১১ হাজার ২৪১ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ধান চাষ হয়েছে। কৃষি গবেষণা ইনিস্টিউটের উচ্চ ফলনশীল ধানের জাতের বাইরে এই অঞ্চলে উচ্চ ফলনশীল পাজাম ধানের ব্যাপক চাষাবাদ হয়। এই চালের ভাত খেতে সুস্বাদু হওয়ার কারণে কৃষকদের এটি খুবই পছন্দ।
পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের সিমান্তে বসবাসকারী কৃষকদের মাধ্যমে সীমান্ত দিয়ে এই ধানের বীজ প্রথমে এই অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং ক্রমেই এর চাষাবাদ বৃদ্ধি ও জনপ্রিয়তা পায়। এই জাতের মধ্যে বেটে, লাল, পাইজাম তিনটি বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে তিনি জানান।
কৃষিবিদ বলেন, আমাদের দেশের কৃষি গবেষণা ইনিস্টিউটের মাধ্যমে প্রায় ১০০ এর ওপরে ধানের জাত আছে। এর মধ্যে উচ্চ ফলনশীল জাতও আছে, তবে কৃষকদের পছন্দের তালিকায় পাইজাম ধানটি বেশ জনপ্রিয়। পাহাড়ে জুম চাষের প্রচলন রয়েছে আউশ মৌসুমে এই অঞ্চলের চাষিরা পাহাড়ে ধানের পাশাপাশি মিশ্র চাষাবাদ করেন তবে জুমে ধান উৎপাদনের দিক থেকে প্রতি হেক্টরে ২-২.৫ টন ধান পাওয়া যায়।
যা খুব একটা বেশি না তাই আমন মৌসুমে জুমিয়াদের সমতল পাহাড়ি জমিতে উচ্চ ফলনশীল পাইজাম ধানের চাষাবাদে কৃষকরা লাভবান হবেন বলে জানান এই কৃষিবিদ। প্রতি বছর সরকার কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান করলেও পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন আঞ্চলিক জটিলতার কারণে কৃষি কাজে ব্যবহৃত সার, কীটনাশক ঔষধ উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় মাঠ পর্যায়ে কৃষকের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত এর বাজার মূল্য সীমাহীন বেড়ে যায় বলে মন্তব্য করেছেন কৃষকরা। এতে সার, কীটনাশক কিনতে না পারার কারণে অনেক আবাদি জমি পতিত অবস্থায় থেকে যায়। সরকার ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আন্তরিক হলে এ সব সমস্যা সমাধান হবে বলে জানান স্থানীয় কৃষকরা।