মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, দায়িত্বের শুরু থেকেই বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও অখণ্ডতার আরও বড় আকারের স্বীকৃতির জন্য চাপ দিয়ে এসেছি। মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এই আন্তঃনির্ভরতার বিষয়টিই সামনে নিয়ে এসেছে।
তার মতে, উন্নত ও শক্তিশালী সার্বজনীন জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। মহামারি এবং বর্তমান খাদ্য-জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে শিক্ষা নিতে হবে রাষ্ট্রগুলোকে। সামাজিক সুরক্ষায় অবশ্যই স্বাস্থ্য সেবা ও দারিদ্র্যের বিপরীতে মানুষের নিরাপত্তা সহজ করার বিষয়টি থাকতে হবে। পাশাপাশি খাদ্য, পানি, আবাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ অপরিহার্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি জানান, চিলির দুবারের প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব থেকে বুঝতে পেরেছি দেশ শাসন কতটা কঠিন। একটি দেশের অনেক চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা থাকে, যার সমাধান করা দরকার। কিন্তু দেশ পরিচালনা করতে গেলে কোনো কোনো বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হয়। সেক্ষেত্রে মানবাধিকার অবশ্যই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে আমার কার্যালয় কাজ করছে। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার রাজনৈতিক ইচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। রাজনৈতিক ইচ্ছাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইচ্ছা থাকলে উপায় বেরিয়ে আসবেই।
মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ন্যায্যতা দিতে কখনোই বিশেষ পরিস্থিতিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা উচিত না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, কলোম্বিয়ায় যেসব কারণে সহিংসতা লেগে আছে, তার একটি কারণের সমাধানের মাধ্যমে সেখানকার কৃষক, আদিবাসী ও আফ্রিকান-কলোম্বীয় সম্প্রদায়কে সুরক্ষা দেয়া সহজ হবে।
তিনি জানান, হাইকমিশনার হিসেবে আমার চার বছরের মেয়াদে বহু সাহসী, উৎস্যুক ও অসাধারণ মানবাধিকারকর্মীর সঙ্গে আমি কথা বলেছি। যার মধ্যে আফগানিস্তানের অদম্য নারী মানবাধিকারকর্মীরা, মেক্সিকোয় নিখোঁজদের আত্মপ্রত্যয়ী মায়েরাও রয়েছেন। আবার গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের বুনিয়ার অঞ্চলের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উৎসাহী কর্মীদের সঙ্গেও কাজ করেছি। তারা যৌন সহিংসতায় আক্রান্তদের জন্য কাজ করছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জানান, পেরুর আদিবাসীদের তেজ ও প্রজ্ঞা দেখেছি। যারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অবৈধ খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও গাছকাটার বিরুদ্ধে সম্মুখসারিতে থেকে কাজ করছেন। গুরুতর ঝুঁকিতে থেকেও তারা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন। এছাড়া বুরকিনা ফাসোর অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দেয়া সম্প্রদায়গুলোর উদারতা ও সহমর্মিতাও আমাদের নজর কেড়েছে।
আরো পড়ুন>> মনপুরা দ্বীপের জন্য তিন মেগাওয়াট হাইব্রিড বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি
তিনি জানান, নাইজারের ঐতিহ্যবাহী গ্রামের নেতাদের মধ্যে আমি মৈত্রী খুঁজে পেয়েছি। তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে মানবাধিকার এগিয়ে নিতে তারা নিজস্ব উপায়ে কাজ করছেন। মালয়েশিয়া, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, কোস্টারিকাসহ বিভিন্ন দেশের তরুণদের সঙ্গে আমি দেখা করেছি, তাদের সম্পদ, সৃষ্টিশীলতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে নাড়া দেয়।
ভেনিজুয়েলার এক বাবার সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা জানান তিনি। তাকে ওই বাবা নিজের কিশোর ছেলের ক্রীড়া পদক দেখান। ২০১৭ সালে ওই পদক পান তার ছেলে। এরপর বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে সে নিহত হয়।
মিশেল ব্যাচেলেট জানান, স্রেব্রেনিকায় ২৭ বছর আগে নিখোঁজ হওয়া সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশায় বেঁচে থাকা মায়ের সঙ্গেও আমার চোখের পানি ভাগাভাগি করেছি। হয়ত একদিন সন্তানের দেহাবশেষ তিনি ফিরে পাবেন, আর বাবার কবরের পাশেই তাকে চিরশায়িত করা হবে।
এরপর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে তার দেখা করার কথা উল্লেখ করেন তিনি। মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, এক শরণার্থী আমাকে জানিয়েছেন যে মিয়ানমারের স্কুলে তিনি ভালো রেজাল্ট করেছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল, তিনি একদিন চিকিৎসক হবেন। কিন্তু তার বদলে গেল পাঁচ বছর ধরে তাকে শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করতে হয়েছে। তাকে নিজ দেশ থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। কারণ তিনি একজন রোহিঙ্গা। অথচ তার বৌদ্ধ বন্ধু এরই মধ্যে চিকিৎসক হয়েছেন। ভেঙে যাওয়া সেই স্বপ্নের কথা স্মরণ করে এখনো কান্নায় তার চোখ ভিজে যায়।
তিনি জানান, শরণার্থী হিসেবে আমার নিজের অভিজ্ঞতা ছিল স্বস্তিদায়ক। শিক্ষা ও মানসম্পন্ন জীবন আমি পেয়েছিলাম। নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসনের যে গভীর আকাঙ্ক্ষা রোহিঙ্গাদের মধ্যে দেখেছি, তা আমার মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, স্বেচ্ছায় সম্মানজনকভাবে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি।
এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। আর মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কায়াহ ও কেয়িন, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিন রাজ্য, বামারদের কেন্দ্রভূমি সাগেইং ও মাগওয়েতে সামরিক বাহিনী তাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
গ্রামীণ ও আবাসিক এলাকাগুলোতে বিমান ও কামান হামলা তীব্রতা পেয়েছে। সম্প্রতি রাখাইন রাজ্যে আবার সহিংসতা বেড়ে যাওয়া এই আভাসই দিচ্ছে যে, দেশটির সর্বশেষ স্থিতিশীল এলাকাও সশস্ত্র সংঘাতের পুনরুত্থান ঠেকাতে পারছে না। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বারবার তাতমাদো ও আরাকান আর্মির যোদ্ধাদের সংঘাতের মধ্যে আটকা পড়েছে। আবার সামরিক বাহিনীর সরাসরি অভিযানেরও শিকার হয়েছে তারা।
মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, মিয়ানমারে নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংস অভিযান বন্ধে ও বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় চাপ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে যে সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে, সে জন্য তাদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসার অনুরোধ করছি।
ইউক্রেনে বেসামরিক নাগরিকদের ভোগান্তি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলে বৈরিতা ফের শুরু হয়ে যেতে পারে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন। সেখানে বেসামরিক নাগরিকদের অনেক ভোগান্তি হয়েছে। নতুন লড়াই শুরু হলে তা তাদের জীবনকে আরও অস্বাভাবিক করে তুলবে।
কাজেই উত্তেজনা কমিয়ে আনার মাধ্যমে শত্রুতা বন্ধে ইথিওপিয়ার সরকার ও টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টকে অনুরোধ জানান মিশেল ব্যাচেলেট। এছাড়া ইয়েমেন, সিরিয়া, সাহেল ও হাইতির পরিস্থিতিসহ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংকটগুলোতে নতুন করে নজর দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তিনি অনুরোধ জানান।