ঘোড়ামারা আজিজসহ ৬ আসামির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় যে কোনো দিন
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
গাইবান্ধার সাবেক সাংসদ জামায়াত নেতা আবু সালেহ মুহাম্মদ আবদুল আজিজ মিয়া (৬৫) ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় জানা যাবে যে কোনো দিন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, আটক, অপহরণ, লুণ্ঠন ও নির্যাতনের তিনটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে এই ছয় আসামির বিরুদ্ধে। প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের দ্বিতীয় দফা যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল গতকাল সোমবার মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি আমির হোসেন ও আবু আহমেদ জমাদারও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর এটি হবে ২৯তম রায়। আজিজ ছাড়া বাকি আসামিরা হলেন- মো. রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জু (৬১), মো. আবদুল লতিফ (৬১), আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী (৫৯), মো. নাজমুল হুদা (৬০) ও মো. আবদুর রহিম মিঞা (৬২)। অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গতবছর ২৮ জুন এই ছয় আসামির বিচার শুরু করে আদালত। আসামিদের মধ্যে লতিফ ছাড়া সবাই পলাতক। এর আগে বিচারিক কাজ শেষে মামলাটি গত ৯ মে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছিল বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু গত ১৩ জুলাই বিচারপতি হকের মৃত্যু হলে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম থমকে যায়। এ অবস্থায় বিচারপতি শাহিনুরকে চেয়ারম্যান করে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দী ট্রাইব্যুনাল থেকে হাই কোর্টে ফিরে যান। তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে নতুন যুক্ত হন বিচারপতি আমির হোসেন ও আবু আহমেদ জমাদার। ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন হওয়ায় বিচারকরা রায় দেওয়ার আগে আবারও এ মামলার যুক্তিতর্ক শোনার সিদ্ধান্ত দেন গত ১২ অক্টোবর। সে অনুযায়ী ২২ অক্টোবর নতুন করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। দুই দিন শুনানির পর গতকাল সোমবার মামলাটি আবারও রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হল। প্রসিকিউশনের পক্ষে যুক্তিতর্কের শুনানি করেন সায়েদুল হক সুমন ও সৈয়দ হায়দার আলী। তাদের সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর শেখ মুশফিক কবির। অন্যদিকে আসামিদের মধ্যে লতিফের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন খন্দকার রেজাউল এবং পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। আজিজসহ গাইবান্ধার এই ছয় জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয় ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর। এক বছরের বেশি সময় তদন্তের পর ছয় খ-ে ৮৭৮ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা, যাতে ২৫ জনকে সাক্ষী করা হয়। তদন্ত সংস্থা ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর ওই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করলে প্রসিকিউশন শাখা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। এর ওপর শুনানি নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গতবছর জুনে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। এর আগে ছয় আসামিকে গ্রেফতারের জন্য ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু পাঁচজনকে গ্রেফতার করা সম্ভব না হওয়ায় তাদের পলাতক দেখিয়েই এ মামলার কার্যক্রম চলে। তদন্ত সংস্থা বলছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৯ থেকে ১৩ অক্টোবর বর্তমান গাইবান্ধা সদর ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান আসামিরা।
আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত প্রথম অভিযোগ: একাত্তরের ৯ অক্টোবর সকাল ৮টা বা সাড়ে ৮টার সময় আসামিরা পাকিস্তানের দখলদার সেনা বাহিনীর ২৫/৩০ জনকে সঙ্গে নিয়ে গাইবান্ধা জেলার সদর থানাধীন মৌজামালি বাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে চার জন নিরীহ, নিরস্ত্র স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে আটক, নির্যাতন ও অপহরণ করে। পরে তাদের দাড়িয়াপুর ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গনেশ চন্দ্র বর্মণের মাথার সঙ্গে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করে এবং বাকিদের ছেড়ে দেয়। আসামিরা আটককৃতদের বাড়ির মালামাল লুণ্ঠন করে।
দ্বিতীয় অভিযোগ: ওই দিন বিকাল ৪টার দিকে আসামিরা সুন্দরগঞ্জ থানার মাঠেরহাট ব্রিজ পাহারারত ছাত্রলীগের নেতা মো. বয়েজ উদ্দিনকে আটক করে মাঠেরহাটের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে। পরদিন সকালে আসামিরা বয়েজকে থানা সদরে স্থাপিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তিন দিন আটক রেখে নির্যাতনের পর ১৩ অক্টোবর বিকালে তাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ মাটির নিচে চাপা দেওয়া হয়।
তৃতীয় অভিযোগ: একাত্তরের ১০ অক্টোবর থেকে ১৩ অক্টোবর আসামিরা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগিতায় সুন্দরগঞ্জ থানার পাঁচটি ইউনিয়নে স্বাধীনতার পক্ষের ১৩ জন চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে আটক করে। তাদের তিন দিন ধরে নির্যাতন করার পর পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পের কাছে নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশ মাটি চাপা দেয়। সেখানে ওই শহীদদের স্মরণে একটি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
ছয় আসামির সংক্ষিপ্ত পরিচয়: জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আজিজ মিয়া ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চার দলীয় জোটের অধীনে গাইবান্ধা সুন্দরগঞ্জ-১ আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে দুটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাসহ ১৩টি মামলা হয়। ২০১৩ সালে সুন্দরগঞ্জ থানায় চার পুলিশ সদস্য হত্যামামলায় অন্যতম আসামি এই আজিজ। বাকিদের মধ্যে জামায়াতের সুন্দরগঞ্জ থানা শাখার সক্রিয় সদস্য রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জুর (৬১) বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দুটি মামলা হয়। মো. আবদুল লতিফ জামায়াতে ইসলামি সক্রিয় কর্মী এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলা পর্যায়ের নেতা। তার বিরুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ থানায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগসহ তিনটি মামলা হয়। আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী মুক্তিযুদ্ধের আগে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র সংঘের সক্রিয় নেতা ছিলেন। পরে জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় কর্মী বলে তদন্ত সংস্থার তথ্যে এসেছে।মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। ১৯৭০ সাল থেকে জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে দুটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হয়। তিনি ১৯৯৫ সাল থেকে বিএনপির সক্রিয় কর্মী হলেও জামায়াতের সমর্থক করে বলে জানা যায়। আর আবদুর রহিম মিঞা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জামায়াতের কর্মী ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন- এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তার মানবতাবিরোধী অপরাধে দুটি মামলা হয়।