মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হয় : এ কারণে অভিভাবকরা বাল্যবিয়ের পক্ষে
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে এখনও বাবা–মায়েদের শঙ্কায় থাকতে হয় মন্তব্য করে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, এ কারণে এখনও অভিভাবকরা বাল্যবিয়ের পক্ষে থাকেন।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনে ‘অক্টোবর বিপ্লব ও নারীমুক্তি আন্দোলন: তাৎপয ও প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক এক সেমিনারে একথা বলেন তিনি। অধ্যাপক সিরাজুল বলেন, আমরা দেখছি বাল্য বিবাহ, এই যে আইন… বাল্য বিবাহের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, তার কারণ হচ্ছে বাবা–মা মনে করে, তার সন্তানকে বিবাহ দিতে পারলে তাদের অন্তত একটা দায়িত্ব কমে যাবে, দায় মুক্তি পাবেন। কন্যা সন্তান জন্ম নিলে নিজেকে তারা বিপদগ্রস্ত মনে করেন। বিবাহ দিয়ে অব্যাহতি পাবেন বলে মনে করেন। সরকার প্রণীত নতুন বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে বিশেষ পরিস্থিতিতে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ের বিধান রাখা হয়েছে। এ ধরনের বিধানে বাল্যবিয়ে উৎসাহিত হবে বলে বিভিন্ন পক্ষ থেকে সমালোচনার মধ্যেই গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদে এ–সংক্রান্ত বিল পাস হয়। প্রসাধন কোম্পানির ব্যবসার প্রসারে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে ‘নারীকে পণ্য’ করে তোলা হচ্ছে বলেও অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, আমরা দেখি বিউটি কনটেস্ট হচ্ছে, এই যে বিউটি কনটেস্ট নিয়ে একটা হট্টগোল হচ্ছে। বিউটি কনটেস্ট হচ্ছে নারীকে পণ্য করা। যারা সৌন্দর্যের প্রসাধন তৈরি করে, সেই সমস্ত কোম্পানিগুলো বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার এই কাজ করে। তারা বলে এই প্রসাধন ব্যবহার করলে তুমি সুন্দরী হতে পারবে, তুমি বিশ্বসুন্দরী হতে পারবে। তাদের বিক্রির জন্য বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা হয়। মেয়েদেরকে এইভাবে পণ্য করে তোলে, যাতে পুরুষের চোখে সুন্দর… কাজেই সে সুন্দরী, বিশ্বসুন্দরী। পশ্চিমবঙ্গের একটি মেয়ে বিশ্বসুন্দরী হল, তখন বলা হল… বুদ্ধিজীবীরা, কেউ কেউ উপ–সম্পাদকীয় লিখলেন, যে বিরাট কাজ হয়েছে। বলা হচ্ছে, আমরা বিশ্ব জয় করে ফেলেছি। আমাদের মেয়ে বিশ্ব জয় করে বিশ্বসুন্দরী হয়ে গেল! সম্প্রতি ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা–সমালোচনার মধ্যে গণমাধ্যমে প্রতিযোগীদের ব্যক্তিগত বিষয় আসার প্রসঙ্গেও কথা বলে অধ্যাপক সিরাজুল। তিনি বলেন, আমাদের মেয়েদের বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বলা হচ্ছে, তার বিয়ে হয়েছিল, নাকি বিয়ে হয়নি, এই নিয়ে কাগজে নিত্য নতুন খোরাক। আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা কিন্তু খবরের কাগজে আসছে না। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন এবং এন্টারটেইনমেন্টের পাতায় দেখবেন যে, আনন্দলোকের কথা দেখবেন, সেখানে কী ধরনের ছবি, কী ধরনের রঙিন ছবি দিচ্ছে। একই পত্রিকা যেখানে ধর্ষণের খবর দিচ্ছে, গণধর্ষণের সংবাদের পাশে এই রঙিন ছবি দেওয়া হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন একটা স্বপ্নের জগৎ। সমাজতন্ত্রের বিপরীতে পুঁজিবাদ ছলে–বলে ও কৌশলে কাজ করে যাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, মানুষের উন্নতির কথা বলে পুঁজিবাদ ছলনা করছে। উন্নতির কল্পকাহিনী দিয়ে অন্যের অবনতি করছে। ৯৫ শতাংশ মানুষ এই উন্নতির নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও যারা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন করেন, তাদের মধ্যে যারা পুঁজিবাদের পক্ষে চলে যান, এর কারণ কিছু উচ্ছিষ্ট সুবিধা পাওয়ার আশায়। পুঁজিবাদ বলও প্রয়োগ করেছে, যারা সমাতান্ত্রিক আন্দোলন করেন, তাদের উপর বিভিন্ন সময় নিপীড়ন হয়েছে, তাদের গুম ও হত্যাও করা হয়েছে, তার ইতিহাস অত্যন্ত নির্মম ইতিহাস। পুঁজিবাদ ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী দিয়ে কৌশল করে থাকে মন্তব্য করে অধ্যাপক সিরাজুল বলেন, ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা প্রচার করতে থাকে পুঁজিবাদ ভাল। সেখানে মিডিয়া… আজকের মিডিয়া হচ্ছে পুঁজিবাদীদের দখলে। তারা নানানভাবে এই পুঁজিবাদের প্রশংসা করতে থাকে, সমাজতন্ত্র যে সম্ভব নয় সেই কথা বলতে থাকে। পুঁজিবাদ এখন ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করেছে। পৃথিবীর নিকৃষ্ট মানুষগুলো সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে মন্তব্য করে দৃষ্টান্ত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা তুলে ধরেন তিনি। এই যে ডোনাল্ড ট্রাম্প, এইরকম একটা উম্মাদ, একটা অর্ধশিক্ষিত মানুষ, সবচেয়ে উন্নত দাবিদার রাষ্ট্রের প্রধান হয়েছে। সেই ব্যক্তি বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমরা দেখতি উদার রাষ্ট্র ভারতে এমন একজন লোক ক্ষমতায় এসেছে, যার কাছে মানুষের চেয়ে গরু অনেক মূল্যবান। গরু রক্ষা করার জন্য সে মানুষ হত্যা করেছে। সে এই দলের লোক, যে দল মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছে। সেই মিয়ানমারের নেত্রী, তার রূপ দেখে অনেকে চিনতে পারেনি, আসলে তারা একই ধরনের মানুষ। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে ভবিষতে নারীদের ভূমিকা আরও বেগবান ও গভীর হবে বলে আশা প্রকাশ করেন অধ্যাপক সিরাজুল। তিনি বলেন, আবার আমাদের যে কাজটি জরুরি তা হল– বিপ্লবকে ধরে রাখতে হবে। বিপ্লবকে তাৎপযপূর্ণ করতে হবে। এর জন্য সোভিয়েত দরকার, গ্রামে–গঞ্জে যারা নারী, শ্রমিক, কৃষকের মুক্তির আন্দোলন করছেন, সেখানে ঘাঁটি তৈরি করতে হবে। প্রগতিশীল নারী সংগঠনগুলোর সহায়তায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি। কমিটির সমন্বয়ক লক্ষ্মী চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর আহ্বায়ক বহ্নিশিখা জামালী, সিপিবি নারী সেলের সদস্য লুনা নূর, নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত বক্তব্য দে। সেমিনারের আগে সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উপলক্ষে শোভাযাত্রা বের করে মুক্তি ভবনের সামনে এসে শেষ হয়।