উচ্চ আদালতের কঠোর নির্দেশনাতেও বন্ধ হচ্ছে না জামিন জালিয়াতি
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
মামলার তথ্য গোপন করে জালিয়াতির মাধ্যমে আসামিরা জামিন নিয়ে নিচ্ছে। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও জামিন জালিয়াতি বন্ধ হচ্ছে না। নথি ও জামিন জালিয়াতির ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে প্রায় ৪০টির মতো মামলা দায়ের করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। তার মধ্যে ফৌজদারি বিবিধ শাখা থেকে ২৪টি, রিট শাখা থেকে ৯টি, ফৌজদারি আপিল শাখা থেকে ২টি মামলা করা হয়। বর্তমানে ওসব মামলা তদন্ত ও বিচারাধীন রয়েছে বলে জানা যায়। আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অস্ত্র, মাদক ও ধর্ষণের মতো চাঞ্চল্যকর অনেক মামলাতেই আসামিরা তথ্য গোপন করে জামিন নিচ্ছে। শুধু তথ্য গোপনই নয়, হাইকোর্টের বিচারপতির নাম ব্যবহার করে ভুয়া আদেশ নামাও প্রস্তুত করা হয়। এমন ভুয়া আদেশনামা দাখিলের মাধ্যমে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছে ইয়াবা মামলার আসামি। সম্প্রতি ভয়াবহ জালিয়াতির ওসব তথ্য উদঘাটনের পর ওসব মামলার আসামির জামিন বাতিল করে দিয়েছে হাইকোর্ট। একইসঙ্গে জালিয়াত চক্র ধরতে গোয়েন্দা সংস্থাকেও তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভুয়া আদেশনামা প্রস্তুতের সঙ্গে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জড়িত কিনা তাও খতিয়ে দেখতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে বলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, অতি সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে ৪টি জামিন জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। তার মধ্যে গাজীপুরের শিশু ধর্ষণ মামলার আসামি বিল্লাল হোসেন গত ৯ মে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। জামিন আবেদনে ধর্ষণের প্রমাণ সংক্রান্ত মেডিক্যাল রিপোর্ট তার আইনজীবী বদলে দিয়েছে। মূল রিপোর্টে ধর্ষণের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও জামিন আবেদনে দাখিলকৃত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। এমনকি শিশুটিকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখানো হয়েছে। বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ২১ বছর। যদিও মামলার মূল নথিতে শিশুর বয়স উল্লেখ রয়েছে ১০ বছর। গাজীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে জামিননামা দাখিলের পর জালিয়াতির বিষয়টি ধরার পড়ে। পরে হাইকোর্টের নজরে আনা হলে মূল নথি পর্যালোচনা করে আসামির জামিন বাতিল করা হয়। একইভাবে সাইফুল ইসলাম আরিফ ওরফে বাবা আরিফ (৩০) কার্তুজ ও এক নালা কাটা বন্দুকসহ গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করে মুন্সীগঞ্জ থানা পুলিশ। ওই আসামির বিরুদ্ধে আরো ৯টি মামলা রয়েছে। ওই তথ্য অস্ত্র মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ওসব তথ্য গোপন করেই আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয় ওই আসামি। তাছাড়া বাস থেকে নামিয়ে এক বাক প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণের মামলায় সম্প্রতি জামিন চান চালক বাদশা মিয়া। তার আইনজীবী দাবি করেন, মামলার আরেক আসামি হেলপার মো. ফারুককে জামিন দেয়া হয়েছে। তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনের প্রেক্ষিতে ফারুকের জামিন সংক্রান্ত নথি তলব করে আদালত। দুটি নথি পর্যালোচনা করে হাইকোর্ট দেখতে পায় দু’জন আসামিই ধর্ষণের ঘটনায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে আদালতে। কিন্তু অভিযোগপত্র ও দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির তথ্য গোপন করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছে ফারুক। জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ায় বিচারপতি মো. শওকত হোসেন ও বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদারের ডিভিশন বেঞ্চ ফারুকের আইনজীবী হারুন অর রশিদ ও জামালউদ্দিনকে তলব করেছে। তাদেরকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। তাছাড়া জালিয়াতি সংক্রান্ত আরো ৫ আবেদনের ওপর আদেশের জন্য দিন আদালতে ধার্য রাখা হয়েছে।
এদিকে আদালতে জালিয়াতির ঘটনা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও বার কাউন্সিল ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শম রেজাউল করিম জানান, আদালতে যে আইনজীবী মামলা উপস্থাপন করছেন তিনি প্রকৃতপক্ষে আইনজীবী কিনা এবং তার স্বাক্ষরে মামলা দাখিল হলো কিনা বিষয়টি কঠোরভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি মামলার তদবিরকারক হিসেবে যিনি থাকেন তিনি প্রকৃত ব্যক্তি কিনা অর্থাৎ ভুয়া ব্যক্তির মাধ্যমে এফিডেভিট সম্পন্ন হচ্ছে কিনা সেক্ষেত্রেও নজরদারি দরকার। উচ্চ আদালতে জালিয়াতির ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক তাদের প্রতি কোনোরূপ অনুকম্পা না দেখিয়ে আইনের আওতায় এনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, জালিয়াত চক্র ধরার জন্য হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিচ্ছে সে অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার তদন্তে যদি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখার কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।