সরকারি কাজে বারো আনাই ফাঁকিবাজি। কোথাও কোথাও ষোল আনাই ফাঁকি। সরকারি বিদ্যালয় কিংবা কলেজের ভবন নির্মাণে রডের পরিবর্তে বাঁশের ব্যবহার এখন নৈমিত্তিক ঘটনা। সরকারি ভবন ও সড়ক নির্মাণে ষোল আনা কাজের বাস্তবায়নে মনোযোগও নেই ঠিকাদারদের। আগ্রহ শুধু কাজ পাওয়া ও বিল তোলায়। সরকারি অফিস ম্যানেজ করে নানারকম চাঁদা দিয়ে কাজ পাওয়ার পর সেই কাজের আর মানও থাকে না। এ কারণে যে সড়ক এক বছর স্বাভাবিক থাকার কথা তা তিন মাসও টেকে না। যে সরকারি ভবন ৫০ বছর স্থায়ী হওয়ার কথা, পাঁচ বছর না যেতেই তাতে ফাটল ধরে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় যন্ত্রাদি সরবরাহেও ফাঁকিবাজি বারো আনা। এসব প্রাতিষ্ঠানিক নানা অনিয়মের তদন্তে কাজ করে চলেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার পরও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বরং কাজের মান দিন দিন খারাপই হচ্ছে। শুধু উন্নয়ন কাজ নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রে ফাঁকিবাজি এখন চরমে। দুদক এখানেও কাজ করছে অসংগতি দূর করতে। এ গেল উন্নয়ন কাজের মানের কথা। কাজ শুরুর আগে আমলাতান্ত্রিক জটিলতারও যেন সীমা-পরিসীমা নেই। নানান ঘাট পেরিয়ে আমলাতন্ত্র শেষ হলে, শুরু হয় ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্য। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করে না কেউই। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় বারো মাসই চলে উন্নয়নের নামে খোঁড়াখুঁড়ি। অভিজাত এলাকা গুলশানের এক অধিবাসীর আক্ষেপ, ‘গত এক বছরে আমরা উন্নয়ন ভোগান্তিতে রয়েছি। আজ ওয়াসা কাজ করলে, কাল করে ডেসা। কয়েক দিন পর টেলিফোন, তারপর রাজউক। কারও সঙ্গে কারও সমন্বয় নেই। এভাবেই চলছে দিনের পর দিন।’ সংকট আরও তীব্র হয়েছে জেলা ও উপজেলাগুলোয়। ভাঙা রাস্তাঘাটে যানবাহনে চড়ে এক জেলা থেকে আরেক জেলা যেতে একদিকে যেমন সময় ক্ষেপণ হচ্ছে অন্যদিকে মানুষের ভোগান্তি পৌঁছাচ্ছে চরমে। সড়কপথে কলকাতা থেকে ফিরে এসে এক সাংবাদিক বললেন, বেনাপোল থেকে যশোর সড়ক মানুষের চলাচলের উপযোগী নয়। মনে হয় যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের চিত্র। যশোর থেকে খুলনা সড়কও বেহাল। নির্মাণকাজের ফাঁকিবাজির কারণে গ্রামে-গঞ্জে উপযোগিতা হারিয়েছে। খোদ পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রকাশ্যে বলেছেন, এক লাখ কোটি টাকার এডিপি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে দেশের চেহারা বদলে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। নির্মাণের কাজে মান বজায় থাকছে না। রাস্তা নির্মাণ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, নিয়ম অনুসারে একটি রাস্তা তৈরির আগে ওই রাস্তার নিচে পানি থাকতে পারবে না। আবার পানি যেন জমতে না পারে সে ব্যবস্থাও করতে হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে রাস্তা তৈরির কিছুদিন পর ভেঙে যাচ্ছে। নিয়ম-কানুন না মেনে কাজ করার কারণেই এমনটা হচ্ছে। জানা যায়, সরকারের প্রকল্পগুলোর কাজের মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বিভিন্ন সময়ে চিঠি দিয়েছে খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও কমিশন। সরকারি কাজের মান বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) গত বছরের ২৪টি প্রকল্পের ওপর সমীক্ষা করে তৈরি করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ‘খুলনার ডুমুরিয়ার একটি সড়ক নির্মাণে ডব্লিউবিএম স্তরে কমপ্যাকশনের জন্য ১০ টনের পরিবর্তে মাত্র ৪ টন রোলার ব্যবহার করতে দেখা গেছে।’ আরও উদাহরণ দিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এভাবেই দেশে নিম্নমানের সড়ক নির্মাণ হচ্ছে।’বাংলাদেশের সাবেক মহানিরীক্ষক ও বর্তমানে দুর্নীতি প্রতিরোধ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, সরকারি কাজের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত ঠিকাদাররা সবাই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকছে তাদের সমর্থক বা সমর্থনপুষ্ট ঠিকাদাররাই শুধু টেন্ডার জমা দিচ্ছেন এবং কাজ পাচ্ছেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এসব ঠিকাদার এতটাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী যে সরকারি কর্মকর্তারাও তাদের কাজের বিষয়ে কিছু বলতে অনেক সময়ই ভয় পাচ্ছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রভাব খাটিয়ে কাজ শেষ হওয়ার আগেই বিল তুলে নিচ্ছেন। আর ঠিকাদার একবার বিল পেয়ে গেলে সেই কাজের বিষয়ে তেমন কিছু করার থাকে না।সরকারি কাজের মান নিয়ে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, সরকারি কাজের ষোল আনার মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বারো আনা ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে চার আনা কাজও হচ্ছে না। আবার কাজই হয়নি কিন্তু প্রকল্পের অর্থ ছাড় হয়েছে সেটাও এ দেশে নতুন কিছু নয়। সেসব ক্ষেত্রে তো ষোল আনাই ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা না হওয়ার সুযোগে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে তৈরি হচ্ছে দেশের বেশির ভাগ সড়ক। রাস্তার মান যাচাই বা নিয়ন্ত্রণও হচ্ছে না। সড়কের মান যাচাইয়ের পর সার্টিফিকেট দেওয়ার রেওয়াজও এখানে নেই। রাজনীতির চাপে কাজ দেওয়া হচ্ছে অদক্ষ ও অপেশাদার ঠিকাদারদের। চাহিদা অনুযায়ী রাস্তার ডিজাইনও নিরূপণ করা হচ্ছে না। ইচ্ছামতো নির্মাণসহ সড়কের মেরামত হচ্ছে। তাই সড়কের স্থায়িত্ব দিন দিন কমে যাচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই ভেঙেচুরে খানখান হচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক।
প্রাইণেট ডিটেকটিভ২৫মার্চ২০১৮/ইকবাল