November 11, 2025, 5:42 pm

সংবাদ শিরোনাম
আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা-মৌলভীবাজারের চার আসনেও মনোনয়ন চূড়ান্ত প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা কলি’ নিতে সম্মত এনসিপি বৃষ্টি আর বাতাসে নুয়ে পড়েছে ধানক্ষেত, দুশ্চিন্তায় কৃষকরা ঝিকরগাছায় নাতিজামাই এর হাতে নানা শ্বশুর খুন র‍্যাব-১৩ এর অভিযানে লালমনিরহাটে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য এস্কাফ (ESKuf) ও গাঁজাসহ ১ জন মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে রংপুরের মোবারক আলী হত্যা মামলার মূলহোতা গ্রেপ্তার নবীগঞ্জে বার বার মেয়ে প*রকিয়া**য় জড়িয়ে পরার কারণে নিজ হাতে খু*ন করলেন পিতা বেনাপোল সীমান্ত থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার। সুনামগঞ্জের ধোপাজান নদীতে রাতের আঁধারে বালু হরিলুট

পাঁচগাও গ্রামে ৩০০ বছরের প্রাচীন রক্তবর্ণা দেবী দুর্গা

বিশেষ প্রতিবেদকঃ

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম পাঁচগাও। দেশ–বিদেশের সর্বত্র দুর্গামূর্তির রঙ সাধারণত একই হলেও এই গ্রামের দুর্গা দেবীর রূপ একেবারেই আলাদা—তিনি রক্তবর্ণা। এই রক্তাভ রূপের পেছনে রয়েছে এক বিস্ময়কর ইতিহাস, যা স্বর্গীয় হরিনারায়ণ ভট্টাচার্য্য রচিত একটি প্রাচীন শারদীয় প্রকাশনা শাশ্বতী–তে প্রথম লিপিবদ্ধ হয়।

অবিভক্ত ভারতবর্ষে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ইতিহাসে পাঁচগাও সুপরিচিত নাম। বৃটিশ আমলে এই গ্রামেই জন্ম নিয়েছিলেন খ্যাতনামা লৌহশিল্পী জনার্দন কর্মকার। এখানেই রয়েছে ভারতবর্ষের বিপ্লবী লীলা নাগের পৈতৃক ভিটে। একাধিক মনীষীর আবির্ভাবে গ্রামটি এক সময় জ্ঞানের আলোয় মুখর ছিল।

প্রায় তিন শতক আগে এই গ্রামে সর্বানন্দ দাস নামে এক সাধকের দুর্গামণ্ডপে মহাদেবীর স্থায়ী অধিষ্ঠান ঘটে। শাস্ত্রে যেখানে দেবীর বর্ণ স্বর্ণাভ বলে বর্ণিত, পাঁচগাওয়ের দুর্গা সেখানে লালবর্ণা। এর সূত্রপাত এক অলৌকিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে।

তৎকালীন সরকারের মুন্সি পদে কর্মরত সর্বানন্দ দাস আসামের শিবসাগরে চাকরি করতেন। এক শারদীয় দুর্গাপূজায় কামাখ্যাধামে কুমারীপূজা করার সংকল্প করেন তিনি। কামাখ্যাধামে মহাষ্ঠমীর কুমারীপূজার পর দেখা যায়, পঞ্চবর্ষীয়া কুমারীর গায়ের বর্ণ হঠাৎ রক্তলাল হয়ে গেছে। বিস্মিত সর্বানন্দ জানতে চান—তার পূজা কি সিদ্ধ হয়েছে? দেবী উত্তর দেন, “হ্যাঁ, তোর পূজা সিদ্ধ। এই বর্ণে তোর গ্রামে আমি আর্বিভূত হয়েছিলাম; এখন থেকে তুই আমাকে লালবর্ণে পূজা করবি।” প্রমাণ হিসেবে দেবী জানান, সর্বানন্দের পাঁচগাওয়ের দুর্গামণ্ডপের বেড়ায় তিনি হাতের ছাপ রেখে এসেছেন।

সর্বানন্দের প্রার্থনায় দেবী সোনার সিথি খুলে দেন এবং নির্দেশ দেন—প্রতি বছর মহাস্নানের সময় এই সোনার সিথি দিয়েই দেবীর স্নান করাতে হবে। বাড়ি ফিরে সর্বানন্দ সত্যিই বেড়ার ওপর দেবীর হাতের ছাপ দেখতে পান।

পরের বছর সর্বানন্দ কামাখ্যাধামের আদেশ অনুযায়ী লালবর্ণা প্রতিমা নির্মাণের উদ্যোগ নেন। প্রথমে গ্রামবাসী শাস্ত্রবিরোধী বলে আপত্তি জানালেও ষষ্ঠীর রাতেই সবার স্বপ্নাদেশে দেবীর লালবর্ণে পূজা নিশ্চিত হয়। সপ্তমীর ভোরে ঢাক–ঢোল, শঙ্খ, ঘণ্টার ধ্বনিতে শুরু হয় মহাসমারোহে পূজা। পরবর্তীতে সর্বানন্দের অপর জ্ঞাতিবাড়িতেও দেবী একই রূপে পূজিত হতে থাকেন।

দুই–তিন বছর পর আবার কামাখ্যাধামে গিয়ে সর্বানন্দ পূজা সঠিকভাবে হয়েছে কিনা জানতে চাইলে কুমারী জানান, নবমীর দিনে দেওয়া শাড়িটি ছিল ছেঁড়া ও নিম্নমানের—যা পরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। দেবীর তুষ্টির জন্য সর্বানন্দ চণ্ডীপাঠ, হোম, প্রতিমা গঠন ইত্যাদির জন্য সংশ্লিষ্টদের আলাদা করে জমি দান করেন। মৃত্যুর আগে তিনি পুত্র কমলচরণ বাবুকে পূজার যাবতীয় নিয়মাবলি লিখিত নির্দেশনা দিয়ে যান।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই নির্দেশনামা অনুসারে পূজা চলে আসছে। কমলচরণ বাবুর আমলে দুর্গা বিসর্জনের সময় ধানক্ষেত নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে ইংরেজ মহুকুমা প্রশাসক স্বয়ং পরিদর্শন করে বিসর্জনের স্বাভাবিক পথ রক্ষা করেন। কথিত আছে, যে ক্ষেতে বিসর্জন হতো, সেখানে ফসল বরাবরই বেশি জন্মাত।

কালীচরণ বাবুর সময়ে একবার ঢাকাইয়া কারিগর দিয়ে আধুনিক ধাঁচে ছোট প্রতিমা গড়া হলে মহাষ্ঠমীতে কালীপদ বাবু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। গুরু রোহিনী ভট্টাচার্য্য সদ্য সম্পন্ন মহাস্নান রোগীর মুখে দেন, এবং এক ঘণ্টার মধ্যে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরপর আর কখনো প্রতিমার রূপ বা পরিমাপে পরিবর্তনের সাহস কেউ করেনি।

১৩৬২ বঙ্গাব্দে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে পূজার আড়ম্বর কিছুটা কমানো হয়। পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় (১৯৭১) পাক সেনারা পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেয় এবং ৭৬ জনকে হত্যা করে। তবে যত চেষ্টাই করুক, দুর্গামণ্ডপ পুড়তে পারেনি। সেই বছর কেবল একটি ঘট বসিয়ে ফুল–বেলপাতা দিয়ে অর্চনা করা হয়।

যুদ্ধকালে দেবীর ৮০ ভরি রূপার মুকুটসহ বহু অলঙ্কার লুণ্ঠিত হয়, কিন্তু কুমারীর দেওয়া সোনার সিথি অলৌকিকভাবে রক্ষা পায়। মুকুট লুণ্ঠনকারী ব্যক্তি পরে পাগলপ্রায় হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। শান্তিবাবু দেশত্যাগের আগে সিথিটি কুলপুরোহিত রাজীব ভট্টাচার্য্যের কাছে নিরাপদে রাখেন; তিনিও প্রাণের চেয়েও বেশি যত্নে সেটি সংরক্ষণ করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ থেকে পুনরায় পূজা শুরু হয়। ১৩৭৮ বঙ্গাব্দেই স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা জনসাধারণের চাঁদায় স্থায়ী পাকা দুর্গামণ্ডপ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। এখনও দেশের নানা প্রান্ত ও বিদেশে থাকা পরিবার–পরিজনরা পূজার সময় ফিরে আসেন। বর্তমানে শান্তিবাবুর পুত্র সঞ্জয় দাস পূজার সমস্ত দায়িত্ব পালন করছেন। বংশপরম্পরায় দেবীর দেওয়া সেই সোনার সিথি অক্ষত রয়েছে এবং আজও মহাস্নানের সময় সেটি দিয়েই দেবীর স্নান করানো হয়। নতুন মন্দিরে আজও প্রতি বছর রক্তবর্ণা দেবী দুর্গার পূজা একই আচার–অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়।

পাঁচগাও গ্রামের এই রক্তবর্ণা দেবী দুর্গা কেবল ধর্মীয় ভক্তির প্রতীক নন; তিন শতকেরও বেশি সময় ধরে এক সমৃদ্ধ লোককথা, অলৌকিক আখ্যান ও পারিবারিক ঐতিহ্যের জীবন্ত দলিল।

অনির্বাণ সামাদ- নিউজ এডিটর অনলাইন

Share Button

     এ জাতীয় আরো খবর