ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে ফোন করে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিপীড়নের খবর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ করার পাশাপাশি পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সহযোগিতা চেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রাখাইনে সেনাবাহিনী নতুন করে অভিযান শুরুর পর গত ২৫ অগাস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ চলছে বলে জানাচ্ছেন তারা। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে ‘সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই’ হিসেবে বর্ণনা করলেও জাতিসংঘ একে চিহ্নিত করেছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রও ইতোমধ্যে জানিয়েছে, তারা রাখাইনের ঘটনাপ্রবাহকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করার কথা ভাবছে। পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যাতে রাখাইনের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হাতে জরুরি ত্রাণ পৌঁছে দিতে সহায়তা করে; ওই এলাকায় যাতে সাংবাদিকদের যেতে দেওয়া হয় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ এসেছে, তার তদন্তে জাতিসংঘকে যেন সহযোগিতা করা হয়- সেজন্য জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে বলেছেন টিলারসন। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি দেখতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সেখানে যেতে দিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। এমনকি সেখানে আইসিআরসি ছাড়া অন্য কোনো সংস্থাকে ত্রাণ দিতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। গত ৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে শুনানিতে কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য ও কর্মকর্তা রোহিঙ্গা নিপীড়ন থামাতে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ অথবা সাহায্য বন্ধের মত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। দীর্ঘদিন সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারের ওপর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ছিল। ২০১৫ সালে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফেরার সময় যুক্তরাষ্ট্র সেসব কড়াকড়ি তুলে নেয়। টিলারসন গত সপ্তাহে বলেন, রাখাইনে যেসব সহিংসতার খবর আসছে, বিশ্ব তা দেখেও চুপ করে থাকতে পারে না। যা ঘটছে সেজন্য আমরা মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বকেই দায়ী করব। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আসিয়ান সম্মেলনে অংশ নিতে আগামি মাসের শুরুতে প্রথমবারের মত এশিয়ার ওই অঞ্চলে যাচ্ছেন। ম্যানিলায় ওই সম্মেলনে মিয়ানমারও অংশ নিচ্ছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে ট্রাম্পের ওই সফরের আগে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপও বাড়ছে। এ সপ্তাহের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, মিয়ানমারের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার মত পদক্ষেপ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের ও আন্তর্জাতিক আইনগুলো পর্যালোচনা করছে ওয়াশিংটন। এদিকে, নতুন কোনো শর্ত না দিয়ে ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যদিও পুরনো ওই চুক্তি ধরে অগ্রসর হতে আপত্তি জানিয়ে আসছে ঢাকা। এই সঙ্কটের কারণে বাস্তুচূত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা যাতে নিরাপদে তাদের ঘরে ফিরতে পারে, সেজন্য নতুন কোনো শর্ত না দিয়ে ১৯৯২ সালের বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন। মিয়ানমার সরকার আগেই জানিয়েছে, ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গাদের তারা ফেরাতে রাজি। কিন্তু ওই চুক্তি এখন আর ‘বাস্তবসম্মত নয়’ জানিয়ে একটি নতুন প্রস্তাব দিয়ে মিয়ানমারের জবাবের অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ। রাখাইনে কয়েকশ বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস থাকলেও ১৯৮২ সালে আইন করে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করে আসছেন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ ও ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে। সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে পালিয়ে আসা চার লাখের মত রোহিঙ্গা গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। আর গত ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নতুন করে দমন অভিযান শুরুর পর ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। বেশ কিছুদিন কূটনৈতিক আলোচনার পর ১৯৯২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি করে, যেখানে রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ওই চুক্তির আওতায় মিয়ানমার সে সময় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। চুক্তি নির্ধারিত যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও ২৪১৫ জন শরণার্থীকে সে সময় মিয়ানমার থেকে আসা বলে চিহ্নিত করা হলেও মিয়ানমার তাদের আর ফিরিয়ে নেয়নি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার মধ্যে গত ১৯ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে সু চি বলেন, ১৯৯২ সালে করা প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রাখাইনের মুসলমানদের ফিরিয়ে নিতে তার দেশ প্রস্তুত। এর ধারাবাহিকতায় সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় এলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দুই দেশ একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের বিষয়ে সম্মত হয়। ওই বৈঠকেই ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতির বদলে নতুন একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এগিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে চুক্তির একটি খসড়াও হস্তান্তর করা হয়। গত ৯ অক্টোবর ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, যে প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালের চুক্তির নীতিমালা ও যাচাইয়ের প্রক্রিয়াগুলো ঠিক করা হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তার তুলনায় অনেকটাই আলাদা। সুতরাং ওই চুক্তি অনুসারে এবার রোহিঙ্গাদের পরিচয় শনাক্ত করার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়। এ কারণে নতুন ওই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব করা হলেও মিয়ানমারের জবাব এখনও বাংলাদেশ পায়নি। পরে ঢাকায় আরেক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের ‘আংশিক ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব’ মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমিত করার ‘কৌশল’ হতে পারে। মিয়ানমার নিজস্ব যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য প্রত্যাবাসন প্রত্যাশীদের সংখ্যা সীমিত করার এবং নানা অজুহাতে কফি আনান কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে বিলম্বিত করতে পারে। বাংলাদেশ বরাবরই বলে আসছে, মানবিক কারণে আপাতত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও তাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। এ সমস্যার পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই; সমস্যার সৃষ্টি ও কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানে নিহিত। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল চলতি সপ্তাহে মিয়ানমারে গিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেন। দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এ সমস্যার সমাধানে ১০টি বিষয়ে একমত্যে পৌঁছায় দুই দেশ। সীমান্ত দিয়ে নতুন করে মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বন্ধ করা; এরইমধ্যে যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের যত দ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে নেওয়া এবং তাদের পুনর্বাসনের জন্য রাখাইনের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করার কথা বলা হয় সেখানে। মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দেশটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের তাগিদ দেওয়া হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। আর গত বুধবার মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা সু চির সঙ্গে দেখা করে আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল তাকে স্পষ্ট করেই বলেন, বাংলাদেশ কোনো সন্ত্রাসীকে প্রশ্রয় দেবে না। কিন্তু অনুপ্রবেশকারীদের দ্রুত ফিরিয়ে না নিলে তাদের অনেকেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে। তখন পরিস্থিতি বাংলাদেশ বা মিয়ানমার- কারও অনুকূলে থাকবে না। ওই সফর শেষে ঢাকা ফেরার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ এই সঙ্কটের দ্বিপক্ষীয় সমাধান চায় এবং সেটাই তিনি নেপিদোতে গিয়ে জানিয়ে এসেছেন। এখন মিয়ানমার এগিয়ে না এলে বাংলাদেশ অন্য কিছু ভাববে।