রুহুল আমীন খন্দকার, ব্যুরো প্রধান :
রাজশাহীর তানারে এসএসসি পরীক্ষায় নির্ধারিত ফি এর বাইরে ফরম পূরন ও অতিরিক্ত ক্লাসের নাম করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বেশকিছু স্কুলের শিক্ষকরা। স্কুলের এ বেপরোয়া নিয়মের কাছে এক প্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।১৫ই ডিসেম্বর ২০১৯ ইং শানিবার সকালে ফেসবুকের মাধ্যমে এই অনিয়মের কথা জানায় তানোর উপজেলার ১নং কলমা ইউনিয়নে বসবাসরত কলমা উচ্চবিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী এক এসএসসি পরীক্ষার্থী।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কলমা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আবুল কালাম আজাদ গত বছরের থেকে এবার শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট ভালো করানোর জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিং ক্লাস করার কথা বলেন, এবং শিক্ষার্থী প্রতি ১,২০০/- (এক হাজার দুইশত) টাকা দাবি করছেন। এর আগে ফাইনাল পরিক্ষার ফরম পূরণের সময় শিক্ষার্থী প্রতি ৩৪০/- টাকা বেশি নেন ঐ স্কুলের শিক্ষকরা। পরীক্ষার আগে স্কুল শিক্ষকদের এ ধরনের শিক্ষা বাণিজ্যের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে একেবারে নিরুপায় হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা।এ নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী কয়েকজন পরিক্ষার্থীর সাথে কথা হলে তারা বলে, আমরা কলমা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের ১০ম শ্রেণীর নির্বাচনী পরীক্ষা শেষ হবার পর যারা ফেল করে তাদের বলা হয় ৫০০/- পাঁচশত টাকা করে দিতে হবে। আর অভিভাবককে স্কুলে আনতে হবে, তাহলে তাদের ফাইনাল পরীক্ষার ফরম পূরন করতে দেওয়া হবে। এর পরে ফেল পড়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ডেকে শিক্ষকরা বলেন আমরা কোচিং করাবো যদি আপনাদের সন্তানদের কোচিং করান তাহলে ফরম পূরণ করার অনুমতি দেবো। অভিভাবকগণ শিক্ষকদের কথা শুনে বাধ্য হয়ে রাজি হয় ছেলে-মেয়েদের কোচিং করাতে। এ ব্যাপারে উক্ত ছাত্ররা আরো বলে, আমদের নির্বাচনী পরিক্ষায় মোট ৫৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২৫ জন ছাত্র-ছাত্রী পাশ করে এবং বাকি ২৮ জন ফেল করে। তাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা চাওয়া হয়, কেউ চাঁদা দিয়েছে আবার কেউ চাঁদা দেইনি। তার পর আমাদের কাছে ফরম পূরণ করার জন্য ১৯২০ টাকা করে নিয়েছেন শিক্ষকরা। কিছু দিন পর আমাদের থেকে ফরমে স্বাক্ষর নেওয়ার সময় দেখি যে লিখা আছে ১৪৯০ টাকা, এক্ষেত্রেও আমাদের কাছে থেকে ৪৩০/- করে বেশি টাকা নিয়েছে । তার পর নির্বাচনী পরীক্ষার সময় শিক্ষকেরা আমাদের বলেন যে, পরীক্ষার পর তোমাদের উপর আমাদের কোনো দায়িত্ব থাকবেনা এটা সরকারও কিছু বলতে পারবেনা যে আপনারা ক্লাস চালাচ্ছেন না কেন? নির্বাচনী পরীক্ষা শেষে একদিন প্রধান শিক্ষক আমাদের স্কুলে ডাকে সেদিন প্রধান শিক্ষকের অনুপস্থিতে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক ওহাব মন্ডল তার বক্তব্যে বলেন যে, আমরা তোমাদের কোচিং করাবো সেখানে সবাইকে বাধ্যতামূলক কোচিং করতেই হবে। তোমরা আমাদের হাত থেকে এখনও বের হতে পারোনি। আমাদের হাতে ৩৫০ নম্বর আছে এবং তোমাদের ব্যাবহারিক খাতার নাম্বারও আমাদের হাতে। তোমরা যদি কোচিং না করো তাহলে কিন্তু আমরা এগুলো নাম্বার দিবো না। একেবারেই কম নাম্বার দিবো যা না দিলেই নয়, আমরা যদি এই সব নাম্বার কম দিয়ে দেই তাহলে কিন্তু তোমাদের ভার্সিটিতে ভর্তি হতে সমস্যা হবে। তিনি আরো বলেন যে, পরীক্ষার আগে পর্যন্ত অর্থাত ৪৮ দিন কোচিং ক্লাস করানো হবে এবং কোচিং এর ফি ১২০০/- (বারশো) টাকা দিতে হবে। এই সব কথা শুনিয়ে শিক্ষক আমাদের জিম্মি করে কোচিং করানো শুরু করে। আমরা ১৫ দিন মত ক্লাস করি এবং দেখি যে আমাদের কোচিং এ ভাল ভাবে পড়ানো হচ্ছেনা তার থেকে বাসাতে পড়াই ভালো অযথা টাকা ও সময় নষ্ট। তারপর সব সহপাঠীরা মিলে পরামর্শ করি যে কেউ কোচিং ক্লাসে আর যাবোনা। বিষয়টি প্রধান শিক্ষক দেখে সবার অভিভাবকদের কাছে ফোন দেই এবং বলে যে আপনার সন্তান স্কুলে আসেনি কেন দেখে দিয়ে পাঠান। তারপর কিছু ফেল পড়া শিক্ষার্থীর বাড়িতেও যান। প্রধান শিক্ষক বাড়িতে গিয়ে বলেন যে কি খবর, ছেলে-মেয়েদের কোচিং এ দিয়ে পাঠাচ্ছেন না কেন ? তারা কিন্তু আমাদের হাতেই আছে। প্রধান শিক্ষকের এই সব কথা শুনে আমাদের অভিভাবকেরাও জিম্মি হয়ে আছেন।এ বিষয়ে এক পরিক্ষার্থীর অভিভাবকের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমার সন্তান কলমা উচ্চবিদ্যালয়ের পরিক্ষার্থী, গত এক মাস যাবৎ স্কুলের ক্লাস বন্ধ করে দিয়েছেন এখন শিক্ষকরা বলছেন যে কোচিং করাতেই হবে। আর তার জন্য ১২০০/- টাকা দিতে হবে। আমার সন্তান বলছে যে কোচিং না করলে স্যারদের হাতে যে নম্বর থাকে তা দেবেনা। এই স্কুলের পরিক্ষার্থীদের আমরা অভিভাবগন প্রায় কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত কেউ কেউ আবার অক্ষর জ্ঞানহীন শিক্ষক যা বোঝায় সেটাই বুঝি। নিজের সংসারের টানা পড়ার মাঝেও অনেক কষ্ট করে ছেলে-মেয়েকে লেখা পড়া করায় যাতে সন্তান মানুষের মত মানুষ হতে পারে। আর সেই শিক্ষকরাই আমাদের এই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে টাকা দাবি করছে। তারা যদি ক্লাস করাতে ইচ্ছুক হন তাহলে তো এখন স্কুল সময়েই পড়াতে পারেন, সরকার তো তাদের অনেক টাকা বেতন দিচ্ছেনি। আমার প্রশ্ন হলো রেজাল্ট ভাল করাতে যদি পরিক্ষার আগে ১মাস কোচিং করতেই হয় তাহলে তারা ২ বছর ধরে কি করালেন। এটি একটি শিক্ষা বাণিজ্য ছাড়া আর কিছুই না আমরা এর প্রতিকার চাই।এ নিয়ে কলমা উচ্চ বিদ্যা লয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আবুল কালাম আজাদের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, আমরা আসলে পরিক্ষার্থীদের ভালোর জন্যই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অতিরিক্ত ক্লাস করলে পরিক্ষার্থীরা একটু ভালো রেজাল্ট করবে আর তাই যে সকল শিক্ষক তাদের এই ক্লাস করাবে সেই শিক্ষকদের পারিশ্রমিক হিসেবে এই টাকাটা চেয়েছি। তবে হুমকির বিষয়টি অস্বিকার করে বলেন, আমি কখনো কোন পরিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকদের হুমকি দয়েনি। আমার বিরুদ্ধে এইটা মিথ্যা বলা হচ্ছে আর আমাদের হাতে তো কোন নাম্বার নাই এটাতো বোর্ড পরিক্ষা।এই অনিয়মের বিষয়ে তানোর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ আমিরুল ইসলামের সাথে কতা হলে তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন আগেই প্রত্যেকটি স্কুলে কোচিং সংক্রান্ত নিতিমালা প্রেরণ করেছি। এই নিতিমালা লঙ্ঘন করে যদি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থ দাবি করে তাহলে সেটা অবশ্যই অপরাধ। আমি এই অনিয়মের বিরোধিতা করছি, দেশের প্রচলিত আইনে এ অনিয়মের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যাবস্থা গ্রহণ করব।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ/১৫ ডিসেম্বর ২০১৯/ইকবাল