ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর শ্যামবাজারের কাছে একটি লঞ্চের ধাক্কায় অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে গেছে মর্নিং বার্ড নামে একটি লঞ্চ। এ ঘটনায় ৩২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন নারী, দুইজন শিশু এবং ২৫ জন পুরুষ। এখনও বেশ কিছু যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন। তবে এর ঠিক সংখ্যা কেউ জানাতে পারেনি। লঞ্চ থেকে ঘাটে নামার প্রস্তুতির সময় ডুবে যান নদীতে। যাত্রীরা সবাই মুন্সিগঞ্জ জেলার। এখন মুন্সিগঞ্জের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেছে। স্বজন হারার আর্তনাদে বুড়িগঙ্গার তীরের বাতাসও ভারি হয়ে উঠেছে। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল, নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড উদ্ধার অভিযান চালায়। নৌ পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মীরাও অংশ নেন উদ্ধার অভিযানে। ছুটে আসা স্বজনদের আহাজারিতে শ্যামবাজার এলাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যায়। নেমে আসে শোকের ছায়া। ডুবে যাওয়া লঞ্চ মর্নিং বার্ড উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ধাক্কা লাগা লঞ্চ ময়ূর-২ আটক করা হয়েছে। এই লঞ্চ দুর্ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এদিকে দুর্ঘটনার পর থেকে দিনভর উদ্ধার কাজের খোঁজ-খবর রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজ সোমবার সকাল ৯ টার দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর শ্যামবাজারের কাছে এই দুর্ঘটনা ঘটে। স্বজনরা জানিয়েছেন, নিহতরা সবাই মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা। তারা ঢাকায় চাকরি ও ব্যবসা করতেন। তারা ঢাকায় থাকতেন না। কর্মের জন্য তারা প্রতিদিন সকালে লঞ্চে ঢাকায় আসতেন এবং কাজ শেষে রাতে আবার লঞ্চে মুন্সিগঞ্জে ফিরতেন। সাক্ষাত মৃত্যু থেকে বেঁচে যাওয়া আবদুর রউফসহ কয়েকজন জানান, তারা লঞ্চ থেকে ঘাটে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এসময়ই ঘটে দুর্ঘটনা।দুর্ঘটনা : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আনুমানিক ৬০ জনের অধিক যাত্রী নিয়ে এমভি মর্নিং বার্ড মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে সকাল ৮টার দিকে সদরঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। সদরঘাটের কাছাকাছি শ্যামবাজারে পৌঁছালে কেরাণীগঞ্জের ডক ইয়ার্ড থেকে এমভি ময়ূর-২ লঞ্চটি নদীতে নামনোর সময় ধাক্কা দেয়। মুহূর্তের মধ্যে তুলনামূলক ছোট মর্নিং বার্ড লঞ্চটি পানিতে তলিয়ে যায়। কয়েকজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও বাকিদের সলিল সমাধি ঘটে। ডোবার সময় কান্নার রোল পড়ে লঞ্চের ভেতরে।বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক ঢাকা নদী বন্দর কর্মকর্তা একেএম আরিফ উদ্দিন বলেন, মর্নিং বার্ড লঞ্চটি সকাল ৯ টার দিকে সদরঘাটে বার্দিং (নোঙ্গর) করার আগ মুহূর্তে চাঁদপুরগামী ময়ূর-২ লঞ্চটি ধাক্কা দেয়। এতে সঙ্গে সঙ্গে তুলনামূলক ছোট মর্নিং বার্ড লঞ্চটি ডুবে যায়। এ সময় লঞ্চটিতে কমপক্ষে অর্ধশতাধিক যাত্রী ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও অনেকেই ভেতরে আটকা পড়েন। তবে ঠিক কতজন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। তিনি জানান, ঘটনার পর পরই ময়ূর লঞ্চটি আটক করা হয়েছে।তবে স্থানীয়দের দাবি, লঞ্চে শতাধিক যাত্রী ছিল। যা ধারণ ক্ষমতার অধিক। এছাড়া ছোট এ লঞ্চটি দীর্ঘ দিনের পুরানো এবং ফিটনেস নেই। ময়ূর লঞ্চটি নির্মাণেও ত্রুটি রয়েছে।খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ও কোস্ট গার্ড। পরে উদ্ধার কাজে যোগ দেয় নৌবাহিনী। এছাড়া নৌপুলিশ এবং বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব ডুবুরি দল এবং স্থানীয় লোকজন উদ্ধারকাজে অংশ নেয়।উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার কাছাকাছি এলাকায় নদীর মাঝখানে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি শনাক্ত করা হয়েছে। ভেতরে আর কারও লাশ আছে কি না, তা তল্লাশি করে দেখা হচ্ছে। ডুবুরিরা দেখেছেন লঞ্চটির ভেতর আরও মৃতদেহ রয়েছে। তবে তা উদ্ধার কঠিন হয়ে পড়েছে। কেননা, লঞ্চটি উপুড় হয়ে থাকার কারণে ভেতরে ঢোকা যাচ্ছে না।কোস্ট গার্ড সদর দফতরের মিডিয়া উইং এর কর্মকর্তা লেঃ কমান্ডার হায়াৎ ইবনে সিদ্দিক ও ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ম্যানেজার শহীদুল ইসলাম সুমন জানান, এখন পর্যন্ত ৩২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুইজন শিশু, পাঁচ জন নারী, ২৫ জন পুরুষ। তারা বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সন্দেহ থাকবে এখনও মরদেহ থাকতে পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোস্ট গার্ডের উদ্ধার অভিযান চলবে। প্রায় ৬০-৭০ ফুট পানীর তলদেশে লঞ্চটি কাত হয়ে স্থিতিশীল রয়েছে। আমাদের সঙ্গে নৌপুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিআইডব্লিউটি ও থানা পুলিশ কাজ করছে।বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের পরিচালক মো. শাহজাহান বলেন, ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধারে সংস্থার নিজস্ব উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর থেকে সকাল ১১ টায় রওয়ানা দিয়েছে। তবে এ রিপোর্ট রাত ৯টায় লেখা পর্যন্ত উদ্ধারকারী জাহাজটি ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়নি। শ্যামবাজার ও মিডফোর্টে কান্নার রোল : দুর্ঘটনার পর হাজার হাজার মানুষ ঘাটে এসে ভিড় করেন। খবর পেয়ে শ্যামবাজার এলাকায় ছুটে আসেন যাত্রীদের স্বজনরা। কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। তাদের আহাজারিতে বুড়িগঙ্গার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। লঞ্চ দুর্ঘটনায় নদী তীরে ভিড় জমানো লোকজনের মাঝেও নেমে আসে শোকের ছায়া। নিখোঁজ যাত্রীদের খোঁজে ঘাটে আসা স্বাজনদের বিলাপ করতে দেখা যায়। অনেক স্বজনকে দেখা যায় নদীতে সাঁতার দিয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ারও চেষ্টা করতে। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশসহ অভিযান পরিচালনা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়।ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা যেসব লাশ উদ্ধার করেছেন, তাদের মধ্যে যমুনা ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার কর্মচারী সুমন তালুকদারকে শনাক্ত করেন তার বড় ভাই নয়ন তালুকদার। তিনি জানান, তাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে এসে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে অফিস করতেন সুমন।নিহত মৃত মনিরুজ্জামানের বড় ভাই আব্দুস সালাম বলেন, মনির ইসলামপুরে একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি করে। প্রতিদিন মুন্সিগঞ্জ থেকে আসা-যাওয়া করে। আজও (গতকাল) ফজরের নামাজ পড়ে ঢাকায় রওনা দেয়। তাদেও বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার সালিমাবাদ থানার আব্দুল্লাপুর।পরিবারের চার-পাঁচজনও এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন। প্রিয়জনদের মৃতদেহ পাওয়ার জন্য তাঁদের ভিড় এখন ঢাকার বুড়িগঙ্গাপাড়ে।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ/২৯ জুন ২০২০ /ইকবাল