মশাহিদ আহমদ, মৌলভীবাজারঃ
৪ বছর পর আলোচিত চা শ্রমিক অবনী বাকতি হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পিবিআই। আজ ৫ মার্চ দুপুরে মৌলভীবাজার জেলা পিবিআই পুলিশ কার্যালয়ে প্রেস বিফিংয়ে লিখিত বক্তব্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ শাহাদাত হোসেন জানান- পরকীয়ার কারনেই কমলগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী চা বাগানের ০৭ নং লাইন অবনী বাকতি হত্যাকান্ড। অবনী বাকতি ফুলবাড়ী চা বাগানের নিয়মিত একজন শ্রমিক ছিলেন। গত ২০১৪ সালের ৩ জানুয়ারি রাতে পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে অবনিকে মারপিট করতঃ হত্যা করিয়া ফুলবাড়ী চা বাগনের মন কুচি কুচি এলাকায় সরু রাস্তার পাশে ফেলিয়া রাখে। এ ঘটনায় কমলগঞ্জ থানার মামলা নং- ০৩(০১)১৪, ধারা-৩০২/৩৪ পেনাল কোড রুজু করতঃ এসআই/ মোঃ জিয়াউর রহমানের উপর তদন্তভার অর্পণ করেন। উক্ত এসআই ০৭ (সাত) মাস মামলাটি তদন্ত করেন। তদন্ত কালে সন্ধিদ্ধ হিসেবে শোক চান প্রকাশ অর্জন করোয়া (৩৪), ফুল চান করোয়া (২৩), মুল চান করোয়া (১৯), সাং-০৭নং লাইন, ফুলবাড়ী চা বাগান, কমলগঞ্জ দেরকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তার বদলী জনিত কারনে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এসআই/ গৌরাঙ্গ কুমার বসু উক্ত মামলাটি তদন্ত শুরু করেন। তিনি এক মাস তদন্ত করেন। পরবর্তীতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এসআই/ লিটন পালন মামলাটি তদন্ত শুরু করেন। তিনি পাঁচ মাস তদন্ত করত মামলাটির কোন ক্লু উদঘাটন করতে না পেরে বিজ্ঞ আদালতে চুড়ান্ত রিপোর্ট সত্য দাখিল করেন। বিজ্ঞ আদালত সিআইডিকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়। সিআইডির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ পরিদর্শক, দেবাশীষ চৌধুরী মামলাটির তদন্তভার গ্রহন করেন। তিনি প্রায় সাত মাস মামলাটি তদন্ত করেন। পরবর্তীতে সিআইডির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ পরিদর্শক, শ.ম.কামাল হোসাইন মামলাটির তদন্ত শুরু করেন। তিনি প্রায় সাড়ে চার মাস মামলাটি তদন্ত করত কোন ক্লু উদঘাটন করতে না পেরে চুড়ান্ত রিপোর্ট সত্য দাখিল করেন। বিজ্ঞ আদালত উক্ত মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিলে পিবিআই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ পরিদর্শক, সুমন কুমার চৌধুরী গত ৪ই সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে তদন্ত শুরু করেন। তিনি মামলাটি সাড়ে চার মাস তদন্ত করাকালীন বিশ্বস্থ সোর্সের মাধ্যমে জানতে পারেন, ভিকটিম অবনী বাকতি @ লব তার প্রতিবেশী রদিপ বাকতি (২৬), দেবাশীষ তন্তবাই (২৭), সীতারাম দ্বয়ের সাথে ঘনিষ্ট ভাবে চলাফেরা করিত। ভিকটিমসহ তারা সকলেই একই স্থানে মদ্য পান করিত। ভিকটিম অবনী বাকতি তাদের সাথে চলাফেরার কারনে সে তার প্রতিবেশী ও বন্ধু রদিপ বাকতি এর বাড়িতে যাওয়া আসা করিত। ভিকটিম অবনী বাকতি রদিপ বাকতির বাড়িতে আসা যাওয়ার কারনে তার কাকী এর সহিত প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। অত্র মামলার ঘটনার অনুমান এক মাস পূর্বে উক্ত সম্পর্কের বিষয়টি রদিপ বাকতি জানতে পারে। এরপর হতে ভিকটিম অবনী বাকতির সাথে রদিপ বাকতির সম্পর্কের দুরত্ব ও মনোমালিন্যতা সৃষ্টি হয়। এই মনোমালিন্যতার জের ধরে রদিপ বাকতি উপরোক্ত অপর দুই বন্ধুদের সহযোগীতায় ভিকটিম কে হত্যা করে থাকতে পারে। গত ২৬ শে জানুয়ারী পুলিশ পরিদর্শক, সুমন কুমার চৌধুরী ইউএন মিশনের জন্য মনোনিত হইলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মোঃ শিবিরুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক উক্ত মামলাটির তদন্তভার গ্রহন করেন। তিনি তদন্তভার গ্রহন করত সোর্স নিয়োগ করে ভিকটিম হত্যা সংক্রান্তে একই কারন খুঁজে পান। সোর্সের প্রাপ্ত তথ্যের যাচাই বাচাই শেষে গত ২৮ শে ফেব্রুয়ারী ভিকটিম হত্যায় মুল সন্দেহভাজন রদিপ বাকতি (২৭) কে গ্রেফতার করা হয়। উক্ত রদিপ বাকতি ভিকটিম অবনী বাকতি কে হত্যায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে বিজ্ঞ আদালতে ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেন। পিবিআই এর সার্বিক তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যে প্রকাশ পায় যে, ভিকটিম অবনী বাকতি তার পিতা মাতার একমাত্র সন্তান ছিল। তার কোন নিকট আত্মীয় ছিল না। অত্র মামলার বাদীর স্ত্রী ভিকটিমের দুঃসম্পর্কের পিসাতো বোন ছিল। ভিকটিম অবনী বাকতি প্রায় সময় তার কাকাতো বোনের বাড়ীতে যাওয়া আসা করিত। ভিকটিম চুনারুঘাট থানাধীন দেউন্দি চা বাগানের জননী বাকতি, পিতা-প্রসেন বাকতিকে বিবাহ করেছিল। পরষ্পরের সহিত বনিবানা না হওয়ায় মাত্র ৩/৪ মাস সংসার করার পর তাদের দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদ ঘটে। ভিকটিম নিঃসন্তান ছিল। বিচ্ছেদের হওয়ার পর থেকে ঘটনার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ১ বছর ভিকটিম তার ঘরে একাকী বসবাস করিত। ভিকটিমের সহিত আসামী শীতারাম, দেবাশীষ ও রদিপ বাকতি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। তারা প্রায় একসাথে ঘনিষ্টভাবে চলাফেরা করিত। ভিকটিম প্রায়ই আসামী রদিপ বাকতির বাড়িতে আসা যাওয়া করিত। আসামী রদিপ বাকতির চাচা অসুস্থ থাকায় ও ভিকটিমের উক্ত বাড়িতে ঘনঘন যাওয়া আসায় তার কাকীমার সাথে ভিকটিমের প্রথমে প্রেম পরবর্তীতে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। আসামী রদিপ বাকতি উক্ত সম্পর্কের বিষয়টি শুনে অপর আসামীদ্বয় শীতারাম ও দেবাশীষকে জানায়। আসামী শীতারাম প্রথমে ভিকটিমকে উক্ত সম্পর্কের কথা জিজ্ঞাসা করত উক্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে সরে যাওয়ার জন্য সতর্ক করে। এই ঘটনার প্রায় মাস খানিক পর অর্থাৎ গত ০৩/০১/২০১৪ খ্রিঃ তারিখে আসামী রদিপ বাকতি ও শীতারাম দুপুর অনুমান ১২.০০ ঘটিকার সময় ফুলবাড়ী চা বাগানে বাঁশ কাটতে গেলে দেখতে পায় যে, ভিকটিম ও তার কাকী অনৈতিক কাজে লিপ্ত। তারা দুজনে মিলে ভিকটিমকে অনৈতিক কাজে বাধা দিলে ভিকটিম তাদেরকে গালিগালাজ করে এবং আসামীদেরকে বলে “আমি এটা করবোই, পারলে কিছু করিস’’। একই দিনে সন্ধ্যার দিকে রদিপ বাকতি, দেবাশীষ @ দেব ও শীতারাম ভিকটিম অবনী বাকতির বাড়িতে যায় এবং উক্ত বিষয়ে পুনরায় তাকে সতর্ক করিলে ভিকটিম আসামীগনের সহিত দূর্ব্যবহার করে। ভিকটিমের দূর্ব্যবহারের কারনে উপরোক্ত আসামীগন ভিকটিমকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটনার দিন রাত অনুমানিক ০৯.৩০ ঘটিকার সময় পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক আসামী ১। শীতারাম (২৮), তার সাথে বল্লম (পিকল) নিয়ে অপর আসামী ২। রদিপ বাকতি (২৭), ৩। দেবাশীষ @ দেব কে সাথে নিয়ে পূনরায় ভিকটিমের বাড়িতে গিয়ে ভিকটিমের সাথে উক্ত বিষয় নিয়ে কথা বলে। রাত আনুমানিক ১০.০০ ঘটিকার সময় উপরোক্ত আসামীগন ভিকটিমকে সুকৌশলে ফুলবাড়ী চা বাগানের ১০ নং সেকশনে মন কুচি কুচি এলাকায় রাস্তার পাশে নিয়ে আসে। মন কুচি এলাকায় আসার পর উপরোক্ত আসামীগন ভিকটিমের সাথে উক্ত বিষয় নিয়ে পুনরায় তর্কে লিপ্ত হয়। তর্কের এক পর্যায়ে আসামীগন ভিকটিমকে বেদম প্রহার করে। পরবর্তীতে আসামী দেবাশীষ @ দেব ভিকটিমকে পাঞ্জা মাইড়া ধরে, রদিপ বাকতি ভিকটিমের দু পায়ে চাপিয়া ধরিলে ভিকটিমের সাথে আসামীগনের ধস্তাধস্তি হয়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ভিকটিম মাটিতে পড়ে গেলে আসামী দেবাশীষ @ দেব ও রদিপ বাকতি ভিকটিমের উপরে হাটু গেড়ে বসে এবং আসামী শীতারাম ভিকটিমের মাথায় বাম কানের উপর পিকল দিয়ে আঘাত করিলে ভিকটিমের মাথার এক পাশ হতে অন্য পাশ দিয়ে ছিদ্র হয়ে যায়। ফলে ভিকটিমের মাথা হতে প্রচুর রক্ত ক্ষরন হয়। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরনের কারনেই ভিকটিম ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আসামীগন ভিকটিমের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে জেনে যার যার মতো চলে যায়। উক্ত হত্যার সাথে জড়িত পলাতক অন্য দুই আসামী শীতারাম (২৮) ও দেবাশীষ @ দেবকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বলে জানিছে পিবিআই। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম ও পুলিশ পরিদর্শক তরিকুল ইসলাম সহ অনান্যরা।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ/৫ মার্চ ২০১৮/রুহুল আমিন